সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকেরহীন তিন বছর

বিনোদন রিপোর্ট
  ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দেখতে দেখতে আরও একটি বছর পার হয়ে গেল বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধা ও অভিনেতা আলী যাকেরের চলে যাওয়ার। ২০২০ সালের আজকের দিনে (২৭ নভেম্বর) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান খ্যাতিমান এই সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ চার বছর ধরে মারণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ৭৬ বছর বয়সে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি করোনাভাইরাস পজিটিভও ছিলেন। কিন্তু চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়- কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে কথাটি অনেকটাই সত্যি। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও তিনি তার কর্মের মাধ্যমে বেঁচে আছেন সংস্কৃতি অঙ্গন এমনকি তার ভক্ত-অনুরাগী ও সহকর্মীদের মাঝে।

অনেক গুণের অধিকারী মুক্তমনা আলী যাকের মঞ্চ ও পর্দায় যেমন বড় মাপের একজন অভিনেতা ছিলেন, বাস্তবেও তিনি অনেক বড় মনের একজন মানুষ ছিলেন। অহঙ্কারকিহীন দিলখোলা, পরিশীলিত, সরল্য মনের মানুষটি ছিলেন অনেকটাই শিশুদের মতো। সর্ব ক্ষেত্রে ছিল তার সফল বিচরণ। ব্যর্থতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। জীবনের যে ক্ষেত্রে তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক।

বরেণ্য এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বর তৃতীয় মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মহিলা সমিতিতে আয়োজন করা হয় 'স্মৃতিতে স্মরণে আলী যাকের' শীর্ষক অনুষ্ঠান। এখানে স্মারক বক্তৃতা, গান, আবৃত্তিতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয় দেশের নাট্যাঙ্গনের কৃতী ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরকে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আলী যাকেরের দীর্ঘদিনের মঞ্চ ও কর্মজীবনের সহযোগী নন্দিত নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, 'আলী যাকের ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী। বাংলাদেশে তিনি নবনাট্য আন্দোলনের অগ্রণীদের অন্যতম। ঢাকায় দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের তিনি পথিকৃৎ। অভিনয় ও নির্দেশনায় তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। কৃতী আলোকচিত্রী। প্রবন্ধ ও কলাম লিখেছেন। অংশ নিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। সংগঠক ও ব্যবসায়ী হিসেবেও আলী যাকের সাফল্যের পরিচয় রেখেছেন।

'স্মৃতিতে স্মরণে আলী যাকের' নামের এই আয়োজনটিতে ছিল দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে স্মারক বক্তৃতা। কলকাতার বিখ্যাত নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী ছিলেন স্মারক বক্তা। তিনি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাটকের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এতে কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয়, এরপর রাজনৈতিক নাটক, গণনাট্য সংঘ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেক্সপিয়ারের নাটক, ইউরোপীয় নাটক, গ্রম্নপ থিয়েটারচর্চা থেকে হালের নাট্যচর্চার বিবর্তন ও পরিপ্রেক্ষিত উঠে আসে। পরে তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক সারা যাকের।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই আলী যাকেরের জীবন নিয়ে 'বিরাজ সত্য সুন্দর' নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। আগুনের পরশমণি গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন কায়াশ্রমের শিল্পীরা। এরপর অনুষ্ঠান এগিয়ে চলে আলী যাকেরের জীবনভিত্তিক রচনা 'সেই অরুণোদয় থেকে' থেকে পাঠ ও তার ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠিত হয় আলী যাকেরের প্রিয় গান, কবিতার আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশনা। জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' কবিতাটি আবৃত্তি করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। নিমা রহমান আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'তুমি কি কেবলই ছবি' ও 'এমন দিনে'। সঙ্গীত পরিবেশন করেন- খায়রুল আনাম শাকিল। মুকুন্দ দাসের 'ভয় কী মরণে' গানটির সঙ্গেও ছিল সমবেত নৃত্য। পাঠে অংশ নিয়েছেন নাসিরুল হক, পান্থ শাহরিয়ার, ফকরুজ্জামান চৌধুরী, মুস্তাফিজ শাহীন, মাহফুজ রিজভী। শেষ পরিবেশনাটি ছিল আসাদুজ্জামান নূরের। তিনি সৈয়দ শামসুল হকের 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটকের ভূমিকাংশ আবৃত্তি করে শোনান।

অনুষ্ঠানে আলী যাকেরের সহধর্মিণী সারা যাকের বলেন, 'আলী যাকের ছিলেন নাগরিকের সব সদস্যের প্রাণের মানুষ। তার শূন্যতা পূরণ হবে না, তবে তার দেখানো পথ ধরেই অব্যাহত থাকবে এগিয়ে চলা।'

নাট্যাঙ্গনের প্রবাদপুরুষ আলী যাকের মঞ্চে নূরুলদীনের সারাজীবন, দেওয়ান গাজীর কিসসা, কপোনিকের ক্যাপ্টেনসহ অনেক নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া টিভির পর্দায় আজ রবিবার, বহুব্রীহিসহ বেশ কিছু নাটকে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। ডাকনাম ছটলু হওয়ায় নাট্যাঙ্গনে তিনি পরিচিত ছটলু নামেই। এ দেশের নাটকের সব অর্জন ও সফলতার অংশীদার আলী যাকের। যেসব নাটকের কাজ করেছেন, এতেই অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রতনপুরে জন্মগ্রহণ করেন আলী যাকের। তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬২ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক করেন আলী জাকের। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন তিনি। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের এই শক্তিমান অভিনেতা পরে এশিয়াটিকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেশের বিজ্ঞাপনশিল্পেরও পুরোধা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শব্দসংগ্রামী ছিলেন আলী যাকের। ১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকটিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আলী যাকেরের মঞ্চাভিনয় শুরু। এরপর ওই বছরই আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। নাগরিকের হয়ে প্রথম অভিনয় করেন 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', নাটকে। এরপর ১৯৭৩ সালে দর্শনীর বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রথম নাটক নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের 'বাকি ইতিহাস' নাটকটি নির্দেশনার মধ্য দিয়ে অভিনেতা থেকে নির্দেশক বনে যান আলী যাকের।

শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আলী যাকের ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, সেলিম আল দীন পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে