শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ২১ খাল কাগজে আছে, বাস্তবে নেই

আলতাব হোসেন
  ১০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

এক সময় ঢাকায় ৪৭টি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলতো সেসব নদীখালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন ঢাকা। প্রবাহমান নদী ও খালের সুবিধাই মুঘলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ রক্ষাসহ রণকৌশল করপোরেশন গড়ে তোলা হয় শহরের খালগুলোকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি দখল-দূষণে সংকটাপন্ন ২৬টি খাল উদ্ধারে নেমেছে ঢাকার দুই সিটি। নগরবাসীর মনে প্রশ্ন জেগেছে বাকি ২১টি খাল হারাল কোথায়?

ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৪৭টি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর খালগুলো উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। তখনো ৪৭টি খাল চিহিৃত করা হয়। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া পস্ন্যানে (ড্যাপ) ঢাকায় মোট খালের সংখ্যা ৪৩টি বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রাজধানী ঢাকার খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে। নদী কমিশনেরও একই প্রশ্ন-এত খাল হারাল কোথায়?

১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ঢাকার খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে ঢাকা ওয়াসা। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা ওয়াসার যোগসাজশে দখল হয়েছে অনেক খাল। ঢাকা ওয়াসা সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাছে ২৬টি খাল হস্তান্তর করেছে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই 'ক্র্যাশ প্রোগ্রামের' মাধ্যমে ঢাকা শহরের প্রধান খালগুলো দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন দুই সিটি মেয়র। গত শনিবার থেকেই ডিএসসিসি খাল পুনরুদ্ধার কর্মসূচি শুরু করেছে। প্রথম দিনে বাংলামোটরের

পান্থকুঞ্জ পার্ক থেকে ধানমন্ডি রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত দীর্ঘ বক্স কালভার্টের পাঁচটি পয়েন্ট পরিষ্কার করা হয়।

আগেও কয়েক দফায় ঢাকার খাল উদ্ধার করে ওয়াকওয়ে এবং খালের দুই পাড়ে বাহারি ফুল ও ফলের গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদ্ধার অভিযানে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এরপর কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবারও দখল হয়ে যায় খাল। দখল-দূষণ আর উচ্ছেদের খেলা চলছে বহু বছর ধরে। এবারের অপরিকল্পিত অভিযান নিয়েও নগরবাসী এমন কথা বলছেন। নগরবিদরা বলছেন-২৬টি খালের কথা বারবার উঠে আসছে। বাকি ২১ খাল কাদের দখলে তা বলা হচ্ছে না। পুরো ৪৭টি খাল উদ্ধার না করলে বিচ্ছিন অভিযানে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে না-বলছেন নগরবিদরা। শুধু খাল নয়, দখল আর দূষণে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থাও নাজুক। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা এই চার নদী রক্ষায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট থেকে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত খাল ছিল, ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে এখন খালের চিহ্ন নেই। ঠিক একইভাবে ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, আরামবাগ, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, নারিন্দা, ধানমন্ডি খালের কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। রাজধানীর অন্যতম পুরনো খাল আদি বুড়িগঙ্গা। মূলত এটি বুড়িগঙ্গার একটি অংশ, যা বুড়িগঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে ধলেশ্বরী ও তুরাগের সঙ্গে। সেই আদি বুড়িগঙ্গা দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে। এমন অবস্থা মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালেরও। শুধু এসব এলাকা নয়, রাজধানী ঢাকার সব খালের চিত্র একইরকম। অনেকগুলো খাল এখন বিলুপ্ত। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আগে খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল তা এখন বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।

ঢাকার খালের ইতিহাস অনুসন্ধানে যে ৪৭টি খালের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কল্যাণপুর প্রধান খালের সঙ্গে আরও ছয়টি খাল সংযুক্ত রয়েছে। এছাড়া ইব্রাহিমপুর, আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া, মহাখালী, বেগুনবাড়ি, গুলশান, বনানী, কাটাসুর, আব্দুলস্নাহপুর, বাউনিয়াবাদ, রূপনগর, দিয়াবাড়ি, শাহজাহানপুর, কাটাসুর, রামচন্দ্রপুর, বাইস ডেকি, হাতিরপুল, পরীবাগ, রাজাবাজার, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, খিলগাঁও, বাসাবো, ধলপুর, মান্ডা, পান্থপথ, গজারিয়া, দক্ষিণগাঁও, নন্দিপাড়া, সুতিখাল, বাড্ডা, গুলশান, মহাখালী, ধানমন্ডি, মেরাদিয়া ও গজারিয়া খাল। এর মধ্যে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ যায়যায়দিনকে বলেন, রাজধানীর ৪৭টি খালের মধ্যে এখন টিকে আছে ২৬টি। ঢাকার চারপাশে চারটি নদীকে ঘিরে যে খালগুলো আছে, যেগুলো বিভিন্ন দিকে দখল হয়ে গেছে বা দূষণের কারণে নদীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না, সেগুলো উদ্ধার করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার মাস্টারপস্ন্যান বাস্তবায়ন হলে শুধু ঢাকার চারপাশে নৌ-চলাচল নয়, ঢাকার মধ্য দিয়েও নৌ-চলাচল সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার যায়যায়দিনকে বলেন, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকাসহ আশুলিয়া, আমিনবাজার, কেরানীগঞ্জ ও সাভারে ৭৭টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী খাল, নদী ও জলাশয় দেখভাল করবে জেলা প্রশাসক। ওয়াসাকে খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওয়াসা পানি নিষ্কাশনের জন্য কিছুটা সচল এমন ২৬টি খাল নিয়ে কাজ করেছে। বাকি খালগুলো তাদের অবহেলায় দূষণ ও দখলে হারিয়ে গেছে। খাল উদ্ধারে রাজনৈতিক শক্তি দরকার। আশা করছি সিটি করপোরেশনের সেই শক্তি আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজউক, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক পরিবহণসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগে খাল ও নদী উদ্ধার সম্ভব হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, খালের উপর সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, তা এক তলা বা দশ তলা হোক। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কোনো নোটিশ দেওয়া হবে না। যতই প্রভাবশালী হোক না কেন ডিএনসিসি পিছু হটবে না। ভাষানটেকে বিল্ডিং ভাঙা হয়েছে। রাজউকের নকশা দেখে সব খাল উদ্ধার করা হবে।

এদিকে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার খালগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে