শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
সড়কে আবারও ময়লার গাড়ির ধাক্কায় সাবেক সংবাদকর্মী নিহত

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত রাজপথ

গাফফার খান চৌধুরী
  ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩৩
ডিএসসিসি'র ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নিহতের ঘটনায় প্রকৃত আসামির বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার মতিঝিলে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা -ফোকাস বাংলা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। গাড়িচাপায় ছাত্র মৃতু্যর জেরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। মূলত সপ্তাহজুড়েই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্ররা হাফ ভাড়ার দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছিলেন। বিক্ষোভকালে রাস্তা অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর ও গণপরিবহণের চালক, হেলপারদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বুধবার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীর মৃতু্যর জেরে আন্দোলন আরও বেগবান হয়েছে। এমন উত্তাপের মধ্যেই যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে বৃহস্পতিবার উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় একটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক সংবাদকর্মী আহসান কবির খানের মৃতু্য। এতে করে বিক্ষোভ আরও দানাবেঁধে ওঠে। তারই জেরে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর টানা আট দিন রাজপথে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। গত দুই দিনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় দুই জনের মৃতু্যর ঘটনা রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা আয়োজন সামনে রেখে সড়ক দুর্ঘটনার জেরে রাস্তা অবরোধের নেপথ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপেস্নক্সের বিপরীত সড়কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন আহসান কবির খান। সঙ্গে থাকা পরিচয়পত্র থেকে জানা যায়, তার পিতার নাম আব্দুল মান্নান খান। মায়ের নাম আমেনা বেগম। জন্ম ১৯৭৫ সালের ৭ মে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিগন্যালের কারণে রাস্তায় যানজট ছিল। সেখানে অন্যান্য যানবাহনের মতো উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়িও যানজটে আটকে ছিল। সিগন্যাল ছাড়ামাত্রই ময়লার গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে এগোতে থাকে। এ সময় গাড়িটি সামনে থাকা একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। মোটরসাইকেলের পেছনে ছিলেন আহসান কবির খান। তিনি ধাক্কা খেয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। তার মাথার উপর দিয়েই ময়লার গাড়িটি চলে গেলে পুরো পিচঢালা পথ রক্তে লাল হয়ে যায়। মাথা পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃতু্য হয়। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে গাড়িটি দ্রম্নত চলে যায়। লোকজন পিছু নিয়েও গাড়ির চালক বা হেলপারকে ধরতে পারেনি। গ্রীনরোড সিগন্যালে আটকা পড়লে গাড়ি রেখেই চালক ও সহযোগীরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা আহসান কবীর খানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গাড়িটি পরে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার নুরুল আমিন যায়যায়দিনকে জানান, নিহত আহসান কবির খান সাত বছর আগে তাদের ওখানে কর্মরত ছিলেন। পেস্টিংয়ে চাকরি করতেন। সাত বছর আগে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান। ব্যক্তিগতভাবে প্রিন্টিংয়ের ব্যবসাসহ অন্যান্য কাজে যুক্ত ছিলেন আহসান। এদিকে, আগের দিন বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হন। এ ঘটনায় গাড়িসহ চালককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকেই নটর ডেম কলেজসহ আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে আসছেন। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নাঈম হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে কলেজের সামনে থেকে মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। সেই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন আশপাশে থাকা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি নটর ডেম কলেজ হয়ে মতিঝিল গিয়ে অবস্থান নেয়। তারা আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন। এতে সাধারণ মানুষ পড়েন দুর্ভোগে। পরে বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের সামনে রাস্তায় অবস্থান নেন। নগর ভবনের গেট আগে থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। বিক্ষোভকারীরা নাঈম হত্যার বিচারসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে নানা স্স্নোগান দেন। তাদের দাবি, শুধু মানুষ নয়, রাস্তায় যেন কোনো প্রাণীও মারা না যায়। তার নিশ্চয়তা চান সরকারের কাছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ থেকে শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা নাঈম হত্যার বিচার চেয়ে বিভিন্ন স্স্নোগান দেন। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে, যথাযথ তদন্ত করে শিক্ষার্থী নাঈমের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। নাঈমের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জেলা শহরের বিভিন্ন রুটে শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। স্কুল-কলেজের সামনে হর্ন ও ওভারস্পিডিংয়ের জন্য জরিমানা দিতে হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের ধরে শিক্ষার্থীরা যাতে প্রশাসনের কাছে সোপর্দ করতে পারে তার অনুমতি দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীর হাফ পাস নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে একাধিক স্পিডব্রেকার নির্মাণ করতে হবে। শহরের প্রতিটি অচল ট্রাফিকলাইটের সংস্কার এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাফিক আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। জেব্রা ক্রসিংয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানামা করালে প্রত্যেক বাসকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সবশেষ নিরাপদ সড়ক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিকে, একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ফার্মগেটসহ আশপাশের এলাকায়। এসব এলাকায় হলিক্রস কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এসব এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তারা রাস্তা অবরোধ করে গাড়ির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছেন। বেইলি রোড ও শান্তিনগরসহ আশপাশের এলাকায়ও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এসব এলাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। তারাও বিভিন্ন যানবাহনের কাগজপত্র চেক করেন। বিকাল তিনটার দিকে পুলিশের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দেন। সার্বিক বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, গাড়িচাপায় ছাত্র মৃতু্যর ঘটনায় বিক্ষোভ হচ্ছে। এটি সত্য, তবে ছাত্রদের বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে অন্য কোনো গোষ্ঠী দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। সামনে মহান স্বাধীনতা দিবসের ৫০ বছর পূর্তির নানা অনুষ্ঠান আছে। সে বিষয়টিও আমাদের মাথায় আছে। বিক্ষোভ কাজে লাগিয়ে কোনো গোষ্ঠী গুজব রটানোর চেষ্টা করছে কি না, তা গভীরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। সরকার বিআরটিসিসহ বাস মালিকদের সঙ্গে বাস ভাড়া কমানোর বিষয়ে বৈঠক করে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান। ২০১৮ সালের ছাত্র মৃতু্যর ঘটনাটিও তারা মাথায় রেখেছেন। সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, পর পর দুই দিনের ঘটনার গভীর তদন্ত চলছে। ঘটনা দুটি নিছক দুর্ঘটনা না অন্য কিছু তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনা দুইটি কাকতালীয়ও হতে পারে। আবার নিছক দুর্ঘটনা হওয়া বিচিত্র নয়। তারপরেও পুরো বিষয়টি তারা গভীরভাবে গোয়েন্দা নজরদারিতে এনেছেন। এমন ঘটনার সঙ্গে ২০১৮ সালের বাসচাপায় ছাত্র নিহতের পর শিক্ষার্থীরা যেভাবে দেশের রাস্তা দখলে রেখেছিলেন, সে রকম কিছু হয় কি না তা তীক্ষ্নভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলন কোনো গোষ্ঠী যাতে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় বাসে হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি রায়হান উদ্দিন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুই নম্বর গেটে তারা কর্মসূচিটি পালন করেন। তবে পুলিশের বাধার কারণে তা পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হয়নি। বিক্ষোভ সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের চট্টগ্রাম নগরের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুর রুদ্র, নগর সমজাতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক মিরাজ উদ্দিন, পটিয়ার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদুল রাফী ও সাধারণ শিক্ষার্থী জামসেদুল হক রিফাতকে আটক করে পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি। তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করায় জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছিল। এজন্য বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে