প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় শত শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যদিও দেশে এখনো বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেনি। তবে দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে তুরস্কের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। ঘনবসতি, পাহাড়, বনভূমি উজাড় করা এবং প্রাকৃতিক জলাধার বেদখল হওয়ার কারণে দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মোতাবেক, গত বছর সারা দেশে ২৪ হাজারের বেশি অগ্নিকান্ডে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকা। অগ্নিকান্ডগুলো ঘটেছিল ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা, বৈদু্যতিক গোলযোগ, জ্বলন্ত বিড়ি-সিগারেট, খোলা বাতির ব্যবহার, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, শত্রম্নতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক আগুন দেওয়া, বাড়ি পোড়ানো, উচ্চতাপ, মেশিনের মিস ফায়ার, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলন, চিমনির স্ফুলিঙ্গ, স্থির বিদু্যৎ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ, গ্যাস লাইনের লিকেজ ও যানবাহনে দুর্ঘটনাজনিত কারণে।
ফায়ার সার্ভিসের গবেষণা বিভাগের তথ্য মতে, এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে সচেতনতার অভাবে। সংশ্লিষ্টরা সচেতন হলে শতকরা ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব ছিল। এতে রাষ্ট্র শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেত। যা দেশীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। অগ্নিকান্ডে কাজ করার সময় আশপাশে থাকা অনেক ভালো জিনিসপত্রও পানি বা আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত পদার্থের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে, যা পরিসংখ্যানে আসেনি। অগ্নিকান্ডে নিহত ৯৮ জনের মধ্যে ৩৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে লাগা আগুনেই মারা গেছেন নারী-পুরুষসহ ৫০ জন।
সূত্রটি বলছে, বাকিরা মারা গেছেন বস্তি, গ্যাস লাইন, গ্যাস সিলিন্ডার, বয়লার বিস্ফোরণ, বিভিন্ন ভবন, যানবাহন ও দোকানপাটে লাগা আগুনে পুড়ে। এছাড়া পুকুর, ডোবা, খাল, হাওড়, বিল ও নদী পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৫৫৬টি। এতে ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকা। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭৬৩ জন পুরুষ ও ১৭৫ জন নারী। আহত হয়েছেন ১০০ জন পুরুষ ও ৪৪ জন নারী।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, অগ্নিকান্ড ছাড়াও গত বছর সড়ক, নৌযান, বিমান, ট্রেন, ভবন ধস, পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়া, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কেমিক্যাল, সুয়ারেজ লাইন, সেপটিক ট্যাংক, লিফট ও পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ২ হাজার ১১৫ জন পুরুষ ও ৪০৪ জন নারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি দুর্যোগের পেছনেই কোনো না কোনোভাবে মানুষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্র্যোগের নেপথ্যেও রয়েছে মানুষের প্রভাব। কারণ মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কোন দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য স্বাভাবিক থাকতে হলে দেশটির মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। অথচ বাংলাদেশে আছে প্রায় ৯ ভাগ বনভূমি। একটি আদর্শ শহর বা নগরীর জন্যও নগরীর মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ উপযুক্ত সড়ক থাকতে হয়। তাহলে সেই নগরীতে যানজটসহ অন্যান্য অযাচিত ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে দিনের পর দিন বনভূমি উজাড় হচ্ছে। সে অনুযায়ী গাছ লাগানো হচ্ছে না। বনভূমি হয়ে যাচ্ছে বিরানভূমি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। মানুষ পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করে সেখানে চাষাবাদ করছে। প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। যে কারণে প্রায় প্রতি বছরই পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক এবং বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর নুরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত কঠোর থাকলেও তার শতভাগ কার্যকারিতা নেই। কারণ দেশের আয়তনের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি। বাড়তি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে অনেকেই বেআইনি পথ বেছে নিচ্ছে। বনভূমি ও পাহাড় উজাড় করছে। নদী, নালা, খাল, বিল ও হাওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধার বেদখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে বাড়তি টাকা রোজগার করছে।
তিনি বলেন, এমন ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। তৈরি হচ্ছে বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি বাসস্থান। অনেক সময়ই বিস্নল্ডিং কোড না মেনেই বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। যা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। এসব বহুতল ভবন ভূমিকম্পের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
এজন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করতে বিস্নল্ডিং কোড অবশ্যই মানতে হবে। কারণ বিস্নল্ডিং কোডে ভূমিকম্প প্রতিরোধক বহুতল ভবন নির্মাণের সার্বিক নির্দেশনা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তুরস্কে ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ টেনে এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভূমিকম্পে তুরস্কে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশে তার চেয়েও কম মাত্রার ভূমিকম্প হলেও অন্তত চার গুণ বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। ঘনবসতি হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেশি হবে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ ভূমিকম্পের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে অতীতে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প না হওয়ার কারণে এ বিষয়ে বাংলাদেশের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।'
বিষয়টি সম্পর্কে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৪টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলোকে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে জানমাল রক্ষায় সাইক্লোন শেল্টারসহ বহু ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।'