বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

অকৃষি খাতে যাচ্ছে আবাদি জমি !

জলবায়ুর প্রভাব
আলতাব হোসেন
  ১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
অকৃষি খাতে যাচ্ছে আবাদি জমি !

বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্প কারখানা, যেখানে-সেখানে বসতভিটা, সড়ক নির্মাণ, অবকাঠামো নির্মাণ ও তিন ফসলি কৃষিজমিতে শিল্প কারখানা নির্মাণের কারণে সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে প্রতিদিন ২ শতাংশ জমি অনাবাদি হচ্ছে। দেশে প্রকাশ্যে কৃষিজমি কমলেও তা দেখার যেন কেউ নেই। সাত বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ল্যান্ড জোনিং প্রকল্প।

পরিসংখ্যান বু্যরোর ২০২২ সালের (বিবিএস) কৃষি শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০৮ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল এক কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার একর জমি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির সম্মুখীন পড়বে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছর এ দেশে ২২ থেকে ২৪ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে। এখনই মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অতি সামান্য। তারপরও যদি কৃষিজমি দ্রম্নত কমতে থাকে, তাহলে এই জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব হতে পারে। বর্তমানে দেশে সর্বোচ বছরে সাড়ে চার কোটি টন খাদ্য শস্য উৎপাদন হচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, এরচেয়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবাদযোগ্য জমি রয়েছে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। আর ৪ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর জমি এখনো অনাবাদি রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলে অনাবাদি জমির পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া দেশে বছরে মাত্র একবার আবাদ হয়, এমন জমি রয়েছে ২১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর। আর বছরে দুইবার আবাদ হয় এমন জমির পরিমাণ ৪১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর। আর তিনবার আবাদ হয় এমন জমি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর। আর চার ফসলি জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৭ হাজার হেক্টর।

বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশের আবাদযোগ্য জমির ৭৫ ভাগ জমির উর্বরা শক্তি আগের চেয়ে কমে গেছে। চাষযোগ্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের সংকট রয়েছে। ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা প্রয়োজন, সেখানে দেশের বেশির ভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এমন বাস্তবতায় উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করার তাগিদ কৃষি বিজ্ঞানীদের।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উর্বরতা হারিয়ে ফসলে নতুন নতুন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ ক্রমাগত বাড়ছে। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে কৃষিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। পাট ও গমসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন কমছে।

বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) বৃদ্ধি পাওয়ায় অসময়ে ফলছে ফল। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক মাঠ জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফ্যামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যশস্যের দাম ২০৪০ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে। এতে গরিব মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০৫০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এ সময় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমে তা আবার কমেও যেতে পারে। ফলে বন্যা ও খরার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। এতে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি এবং কৃষি উৎপাদনে বাড়বে নতুন নতুন রোগবালাই।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবেশে তাপমাত্রা বাড়ছে, এটা এখন স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসে অসময়ে। ২০১৯, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে খরায় পুড়ে ফসলের মাঠ। ২০২০ সালের দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় হাওড়ের ফসলহানি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সঠিক সময়ে জমি চাষ, বীজ বপন, ফসল পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। অসময়ে ধানের ফুল আসছে। ধানে ছিটা হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিবর্তন হওয়ায় খরা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর বৈরী আচরণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আরও বেশি খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিতে পড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানি বাড়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন দৃশ্যমান। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে। সম্ভাবনার চেয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া অন্যতম।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এতে হুমকিতে পড়েছে কৃষির উপখাত মৎস্য সেক্টর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ ও উৎপাদনের পরিমাণে পরিবর্তন আসছে, ভবিষ্যতেও এ পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে। পানির স্বল্পতা ঘটবে, কমে যাবে মাটির উর্বরাশক্তি। পাশাপাশি নতুন নতুন বালাই দেখা দিচ্ছে। এমনি অবস্থায় কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। সেচের ব্যাপকতা, ভূমিক্ষয়, মৎস্য বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, রাসায়নিকের ব্যবহার পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়সহ অনেক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিশ্বব্যাংকের কৃষি পরামর্শক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের কৃষি উৎপাদনের ওপরে পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য যেসব ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে, তা কৃষকের কাছে ভালোমতো পৌঁছাচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমন উৎপাদনের ওপর। যার ফলে কৃষকই সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। তাই পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ধানের জাত উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ না দিলে কৃষকরা ধান উৎপাদন থেকে সরে এসে উচ্চমূল্যের কৃষি ও সবজির দিকে মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এতে ধান উৎপাদন কমে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জলবায়ু বিষয়ক গবেষক ডক্টর আসাদুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত হলো কৃষি। উচ্চ তাপমাত্রা আউশ, আমন ও বোরো ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের ফলন কমবে। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বিকিরণ, কীটপতঙ্গ, রোগজীবাণু ও অণুজীবসমূহের বৃদ্ধি ঘটায়। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। দেশের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে ধানের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৬১ শতাংশ কমে যাবে। ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালের মধ্যে ২০০২ সালের তুলনায় ৪.৫ মিলিয়ন টন কমতে পারে। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে লবণাক্তপ্রবণ এলাকায় ধানের ফলন কমে গেছে। বিশেষত, পটুয়াখালী জেলার ধানের গড় ফলন জাতীয় গড়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ এবং নওগাঁর তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। সহনীয় পর্যায়ের জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যকল্পে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের কারণে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালে ১.৬০ শতাংশ এবং ২১০০ সালে আরও ৫.১ শতাংশ কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আইপিসিসির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে সার্বিকভাবে কৃষির উৎপাদন শতকরা ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।

এরপরও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।

এ বিষয়ে ভূমি অধিদপ্তরের ম্যাপ্রিং শাখার কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, দেশব্যাপী মৌজা ও পস্নটভিত্তিক ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিংয়ের কাজ চলছে। এই জোনিং ম্যাপ তৈরির জন্য হাইরেজুলেশন স্যাটেলাইট ইমেজ, রিমোট সেন্সিং ডাটা ও জিপিএসসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই জোনিং ম্যাপে কৃষি, জলাধার, বন, পাহাড়, বসতি, শিল্প, অর্থনৈতিক এলাকা ইত্যাদি চিহ্নিত করা থাকবে। ভূমি ব্যবহার আইন প্রয়োগ করে দেশের মূল্যবান কৃষিজমি, জলাধার, বনভূমি ও পাহাড়-টিলা রক্ষা করা হবে এবং শিল্পায়ন তথা উন্নয়ন কাজের জন্যও প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে