বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্নমানের যন্ত্রপাতিতে জ্বালানি অপচয়

বিদু্যৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে। যা দেশে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ
সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ জুন ২০২৩, ০০:০০
নিম্নমানের যন্ত্রপাতিতে জ্বালানি অপচয়

দেশে যেসব বৈদু্যতিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগ নিম্নমানের। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে ব্যাপক বিদু্যতের অপচয় হচ্ছে। এছাড়া বিদু্যৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে। যা দেশে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

জ্বালানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে মোট জ্বালানির ৪৮ ভাগ শিল্প এবং ৩০ ভাগ আবাসিক খাতে ব্যবহৃত হয়। প্রযুক্তির পরিবর্তন ও দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে শিল্পে ৩১ ও আবাসিকে প্রায় ৩৬ ভাগ জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের একাধিক গবেষণাতেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। অথচ দেশে জ্বালানির চরম সংকট থাকলেও অপচয় কমাতে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তবে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদু্যৎ ও জ্বালানির অপচয় রোধে এবার সাশ্রয়ী বৈদু্যতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের পর এবার বাণিজ্যিক ও ব্যক্তি খাতে অপচয় বন্ধে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে এখন থেকে বিদু্যৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার, উৎপাদন কিংবা আমদানিতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার 'যন্ত্রপাতির জ্বালানি দক্ষতার লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০২২' শিরোনামের এই প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করেছে। আইনগত কাঠামোর মধ্যে লেবেলিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলে এ খাতে কমপস্নায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এতে বিদু্যৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাগজে-কলমে জ্বালানি অপচয় রোধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে দেশে এখনো বাসা-বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা সবখানেই নিম্নমানের বৈদু্যতিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া সারা দেশের বাজার নিম্নমানের বৈদু্যতিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতিতে সয়লাব। এর একটি অংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা গোপন আঁতাত করে নামে-বেনামে অর্ধশতাধিক কোম্পানি এসব পণ্য উৎপাদন করছে। বাজারে বিক্রীত নিম্নমানের বৈদু্যতিক যন্ত্রপাতির বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। যদিও দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত এসব পণ্যের একটি বড় অংশ 'এনার্জি সেভিংস' বলে দোকানিরা বিক্রি করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে গত কয়েক বছরে 'সাশ্রয়ী' বৈদু্যতিক বাল্বে (এনার্জি ইফিশিয়েন্ট বাল্ব) সয়লাব হয়ে গেছে। অনুমোদন নিয়ে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান এসব বাল্ব দেশে উৎপাদন ও বিপণন করছে। কিন্তু নামে-বেনামে অর্ধশতাধিক কোম্পানির নিম্নমানের বাল্ব বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব মানহীন বাল্ব বিক্রি আইনসম্মত নয়। এছাড়া ফ্যান, মোবাইল

চার্জার, চার্জার লাইট, সুইচ, ফ্যানের ক্যাপাসিটর, গিজার ও আয়রনসহ অন্য যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই নিম্নমানের। এমনকি ছলছাতুরির আশ্রয় নিয়ে আমদানিকৃত বৈদু্যতিক পণ্যের মানও সন্তোষজনক নয়। যা সামান্য পরীক্ষা করলেই সহজে জানা যাবে। অথচ এ ধরনের কার্যকর উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। যদিও নিম্নমানের বৈদু্যতিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) অনিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিউব লাইটের ভালো মানের ব্যালেস্ট, ফ্যানের ইলেকট্রনিক্স রেগুলেটর ও উন্নতমানের ইনভার্টার এসি ব্যবহার করলে বিদু্যতের অপচয় কমে আসবে। এছাড়া যেসব বৈদু্যতিক বাতি সত্যিকার অর্থেই এনার্জি ইফিশিয়েন্ট তা ব্যবহার করলে ব্যাপক বিদু্যৎ সাশ্রয় হবে। এছাড়া অদক্ষ ও নিম্নমানের বৈদু্যতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার বন্ধ করলেও অপচয় রোধে সহায়ক হবে বলে জানান তারা।

এদিকে, বাংলাদেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সরকার এখন পর্যন্ত দৈনিক সরবরাহ করে ৩০০ কোটি ঘনফুট। এই গ্যাসের মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা আমদানি করা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি দিয়ে মেটানো হয়।

অথচ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জ্বালানি অপচয়ের মূল কারণ আমাদের সিস্টেম। এর পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা অপচয় রোধ করতে পারি। কেবল আমাদের বাসাবাড়ির ব্যবহৃত চুলার নকশা পরিবর্তন করে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় রোধ করা যায়। এছাড়া শিল্প কারখানায় বিধিবদ্ধভাবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরও ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব।

পেট্রোবাংলার সূত্র এবং গবেষকরা বলেন, পুরনো বিদু্যৎকেন্দ্র ও সার কারখানার অদক্ষ যন্ত্রপাতি এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের সেকেলে প্রযুক্তির বয়লার গ্যাস অপচয়ের প্রধান কারণ। এছাড়া আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতেও বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। তারা বলেন, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় ২৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে যে পরিমাণ বিদু্যৎ, সার ও শিল্পপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যন্ত্রপাতির দক্ষতা বাড়ানো হলে তাতে সর্বোচ্চ ২১০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস লাগার কথা নয়। অর্থাৎ বর্তমানে চাহিদার তুলনায় দেশে দৈনিক গ্যাসের যে ঘাটতি রয়েছে, অপচয় বন্ধ করে তার প্রায় অর্ধেকটাই পূরণ করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি অপচয়ের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। যুগের পর যুগ নিম্নমানের যন্ত্রপাতি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় করা হয়েছে। এখন জ্বালানি সংকট দেখা দেওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিছু কাজও শুরু হয়েছে। বেসরকারি খাতের অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে। সরকারও তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

শিল্প কারখানার মালিকরাও অনেকে জ্বালানি অপচয়ের কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, শুধু মানহীন যন্ত্রপাতিই নয়, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও লোকবলও বিদু্যৎ-গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী। তারা এর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, দেখা গেছে ছয়তলা ভবনবিশিষ্ট একটি কারখানায় সর্বোচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানি দক্ষ বয়লার স্থাপন করা হয়েছে। তবে এটির অবস্থান ভবনের নিচতলায়। অন্যদিকে কারখানায় তৈরি পোশাক আয়রন করার টেবিল স্থাপন করা হয়েছে পাঁচতলায়। বিজ্ঞানের খুব সাধারণ সূত্র থেকে এটা বোঝা যায় যে, নিচতলা থেকে পাঁচতলায় স্টিম নেওয়ার ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ বেশি প্রয়োজন হয় বলে অতিরিক্ত গ্যাস খরচ হয়। যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের দুর্বলতা।

কেবল যে পোশাক শিল্প কারখানাতেই জ্বালানির অপচয় ঘটছে, তা নয়। এ শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড়ের ডায়িং কারখানাগুলোতেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ক্ষেত্রে একই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্বলতা আরও বড় রূপ নিচ্ছে দক্ষ ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে। সম্প্রতি দেশে জ্বালানির দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে উলেস্নখযোগ্য হারে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন বা নকশার ত্রম্নটি ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) অধ্যাপক ডক্টর হাসান মোহাম্মদ মোস্তফা আফরোজ বলেন, আমাদের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে জ্বালানির প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি অপচয় কমানোর ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বা যে ধরনের ব্যবস্থাপনা করা উচিত, সেখানে ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ত্রম্নটি তো রয়েছেই।

এদিকে, কারখানার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ত্রম্নটি ও অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন নিট পোশাক প্রস্তুতকারকদের অনেকেই। পাশাপাশি তারা এসব সমস্যা দূর করতে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবলের ঘাটতির কথাও উলেস্নখ করেন। আবার লোকবল থাকলেও তাদের যথাযথ দক্ষতার ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, স্টিম যত দূরে যায় ততই চাপ কমে যায়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যেন স্টিম কাছাকাছি রাখা যায়। তবে অনেক সময় স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে দূরে বসাতে হয়। তবে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানি ব্যবস্থা স্থাপনের সঙ্গে কোনো আপস করা হয় না বলেও দাবি তার। এটা ঠিক যে সব সময় দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারণ এগুলো ব্যবহার করার জন্য যে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল প্রয়োজন, দেশে তার ঘাটতি রয়েছে- যোগ করেন তিনি।

কিছু কারখানায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনগুলোর ত্রম্নটি রয়েছে, স্বীকার করে এ নেতা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এসব কারখানার জ্বালানি ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। কিন্তু এখন যে কারখানাগুলো হচ্ছে, সেগুলো সব দিক পরিকল্পনা করেই হচ্ছে। প্রতিনিয়ত জ্বালানি ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ দুর্বলতার হার আরও কমিয়ে আনার বিষয়েও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে