শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বছরে গচ্চা ৩৩৭ কোটি টাকা!

ওয়াসার 'সিস্টেম লস' কারসাজি
সাখাওয়াত হোসেন
  ১১ জুন ২০২৩, ০০:০০
বছরে গচ্চা ৩৩৭ কোটি টাকা!

ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উৎপাদন করে, তার প্রায় ২০ ভাগ 'সিস্টেম লস' (কারিগরি অপচয়) হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ কাগজে-কলমে প্রতিদিন ওয়াসার গড় উৎপাদন ২৮০ কোটি লিটার হলেও গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করে ২২৪ কোটি লিটার। বাকি ৫৬ কোটি লিটার নষ্ট হচ্ছে। এই পানি অপচয়ের জন্য সংস্থাটির বছরে ক্ষতি অন্তত ৩৩৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত কয়েক দিনের তীব্র গরম পানির যে অতিরিক্ত চাহিদা বেড়েছে এবং লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন যতটা কমেছে- সিস্টেম লসের কারসাজি বন্ধ করা গেলে তা অনেকটাই সামাল দেওয়া যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ওয়াসার প্রকৌশলী ও রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ঢাকা ওয়াসার দিনে উৎপাদিত পানির ৩৯ শতাংশ অপচয় হতো। ২০২০ সালে পাইপ স্থাপনের প্রকল্প কাজের প্রায় ৬১ শতাংশ শেষ হওয়ায় সেটি কমে ২০ শতাংশে এসে ঠেকেছে। তবে পুরনো লাইন ও ছিদ্রের কারণে প্রকৃত সিস্টেম লস ৫ শতাংশের বেশি হওয়ার নয়। বাকি ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত সিস্টেম লসের বড় কারণ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে পানি চুরি এবং কিছু মিটার পরিদর্শকের কারসাজি।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা নাগরিক সংগঠন এবং নগরবিদরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার বড় প্রমাণ। সংস্থাটি সিস্টেম লসের যে কথা বলছে, তার অধিকাংশ আসলে 'চুরি'। ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পানির অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে টাকা নেয়।

ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সরবরাহ লাইনে ত্রম্নটি ও অবৈধ সংযোগ সিস্টেম লসের বড় কারণ। সিস্টেম লস কমাতে পুরো ঢাকাকে ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়ার (ডিএমএ) আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা। কিন্তু প্রকল্পের গতি ধীর হওয়ায় অগ্রগতি কম। ডিএমএ চালু হলে কত পানি উৎপাদিত হচ্ছে, কতটা ব্যবহৃত হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে হিসাব পাওয়া যাবে। এতে দুর্নীতি কমবে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ওয়াসার বোর্ড সভায় 'সিস্টেম লস' ও পানি 'চুরি' নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা ওঠে। প্রায় প্রতি বোর্ড সভাতেই ওয়াসার পক্ষ থেকে সিস্টেম লস কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই প্রতিশ্রম্নতি পূরণ হয়নি। চুরি ও মিটার পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত থাকলেও কখনো কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করতে কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। ওয়াসার খাতায়ও এটি 'নন রেভিনিউ ওয়াটার'।

ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদনে প্রকৃত খরচ কত- তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব কেউ দিতে না পারলেও ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রতি এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ গড়ে ২৫ টাকা। তবে ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ দুই উৎস মিলিয়ে প্রতি এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২১ থেকে ২২ টাকার মতো।

তবে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পানির উৎপাদন খরচের যে তথ্য তিনি দিয়েছেন তা বাস্তবসম্মত নয়। ২৫ টাকা উৎপাদন খরচ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা পানির। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৬৫ ভাগই গভীর নলকূপ বা ভূগর্ভস্থ উৎসের। বাকি ৩৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা। ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ দুই উৎসের গড় উৎপাদন খরচ ২০ টাকার কম বলে দাবি করেন তারা।

ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী ২০ শতাংশ সিস্টেম লস ধরে গড়ে প্রতিদিন ৫৬ কোটি লিটার পানি নষ্ট হলে বছরে ২০ হাজার ৪৪০ কোটি লিটার পানির অপচয় হচ্ছে। ৫ শতাংশ প্রকৃত সিস্টেম লস বাদ দিলে অতিরিক্ত ১৫ হাজার ৩৩০ কোটি লিটার পানি অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে চুরি, মিটার পরিদর্শকদের কারসাজি ও নানা দুর্নীতির কারণে গচ্চা যাচ্ছে। গড়ে প্রতি এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২২ টাকা ধরা হলে অতিরিক্ত অপচয় হওয়া পানির জন্য ক্ষতি দাঁড়ায় ৩৩৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যার দায় ও ভোগান্তি দুই'ই গ্রাহকের ঘাড়ে চেপেছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঢাকা ওয়াসা সিস্টেম লস ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে পানির দাম বাড়ানোরও যেমন প্রয়োজন হতো না, তেমনি তীব্র গরমেও অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে পানি সরবরাহ করা যেত। সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে না পারার পেছনে কৃর্তপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মই দায়ী বলে মনে করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে নগরবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর পস্ন্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা সেবামূলক মনোবৃত্তিতে নেই। বরং বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানো এবং পানির দাম বাড়িয়ে মুনাফা করাই তাদের লক্ষ্য। ওয়াসার অদক্ষতার দায় জনগণকে কেন টানতে হবে, সরকারের এই জবাবদিহি চাওয়া উচিত।

এদিকে শুধু সিস্টেম লসের কারসাজিতেই নয়, ঢাকা ওয়াসার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত পানির বিল আবাসিক রেটে দেওয়ায় প্রতি মাসে বিপুল অংকের অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, প্রতিটি দুর্নীতির সঙ্গে নিম্নস্তর থেকে শুরু করে উঁচু স্তরের বিপুল সংখ্যক কর্মচারী-কর্মকর্তা জড়িত থাকায় তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত এক হাজার লিটার পানির দাম আবাসিক পর্যায়ে ১৫.১৮ টাকা এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে তা ৪২ টাকা। অর্থাৎ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকের চেয়ে ২৬.৮২ টাকা বেশি। এই সুযোগে ওয়াসার এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাকা মহানগরীতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পানির বিল আবাসিক রেটে করিয়ে দিয়ে প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উত্তরা, গুলশান ও বনানীসহ ৫টি অভিজাত এলাকার আবাসিক ভবনে সাড়ে ৬ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া নগরীর পলস্নবী, মিরপুর, লালমাটিয়া, খিলগাঁও ও মালিবাগসহ অন্যান্য আবাসিক এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ভবনের নিচতলা, এমনকি অনেক বাড়ি দোতলা-তিনতলাতে ফাস্টফুড-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ছোট-বড় দোকানপাটসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বাণিজ্যিক হলেও প্রায় ১৫ হাজার প্রতিষ্ঠান আবাসিক রেটে পানির বিল দিচ্ছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ৩ হাজার টাকা করে কম বিল পরিশোধ করলে মাসে ওয়াসার সাড়ে ৪ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। এ হিসাবে শুধু বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত পানির বিল আবাসিক রেটে দেওয়ায় ওয়াসার ৫৪ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। যদিও ওয়াসার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ টাকার একটি অংশের ভাগ পাচ্ছেন। যা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।

স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে আবাসিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে ওয়াসার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, আইন অমান্য করে বাড়িমালিকরা আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়ার কারণে তারা গোপনীয়তার সঙ্গে এ লেনদেন করছেন। লাইনম্যান ও মিটার পরিদর্শক থেকে শুরু করে জোনাল অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই উপরি এ অর্থের ভাগ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউই এ অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি। তাদের ভাষ্য, আবাসিকে ভাড়া দেওয়া ছোটখাটো কিছু দোকানপাটে হয়তো বাণিজ্যিক বিল নেওয়া হচ্ছে না। তবে আবাসিক ভবনে যেসব বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা অন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং যেখানে পর্যাপ্ত পানি ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানে বাণিজ্যিক রেটেই তারা বিল আদায় করছেন। আবাসিক লাইন নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ পাওয়া গেলে ওই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।

যদিও ওয়াসার একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ কারসাজির কথা স্বীকার করেন। তারা জানান, ঢাকার বেশিরভাগ আবাসিক এলাকাতেই এখন অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক রেটে ওয়াসার বিল দিচ্ছে। বাকিরা আবাসিক রেটেই বিল পরিশোধ করছে। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক লাইন সংযোগ দেওয়ার বৈধ সুযোগ নেই বলেও জানান তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে