বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ডেঙ্গুতে মৃতু্য : উদ্যোগ নেই কারণ পর্যালোচনার

সাখাওয়াত হোসেন
  ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
ডেঙ্গুতে মৃতু্য : উদ্যোগ নেই কারণ পর্যালোচনার

দেশে ২০১৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে মৃতু্য হয় ১৬৪ জনের। এ হিসাবে ওই বছর ডেঙ্গুতে মৃতু্যর হার শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। যা ২০২১ সালে এসে বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশে। ২০২২ সালে ডেঙ্গু মহামারিতে আক্রান্ত ৬২ হাজার ৩৮২ জনের মধ্যে মারা যায় ২৮১ জন। এ হিসাবে মৃতের হার এক লাফে বেড়ে দশমিক ৪৫ শতাংশে এসে ঠেকে। চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত এ হার শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও জটিল রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে চলতি বছর শেষে মৃতু্যর হারে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুতে মৃতু্যর হার প্রতি বছর কেন বাড়ছে তা খুঁজতে ডেথ রিভিউ (মৃতু্যর কারণ পর্যালোচনা) করা জরুরি। এতে মৃতু্যর হার কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। অথচ এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ বলেন, রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণে মৃতু্য হতে পারে কিংবা ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা ঠিক না হওয়ার কারণে মৃতু্য হতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। ডেথ রিভিউ করলে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। আর এ তথ্য পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব। যে ধারায় চিকিৎসা চলছে, তার পরিবর্তন করে মৃতু্য কমানো যায়। অথচ দেশে তা হচ্ছে না।

মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক রোগীই শারীরিক পরিস্থিতি জটিল না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে আসছে না। কেউ কেউ এমন সময় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে যে, তারা ওইসব রোগীর চিকিৎসা করারও সুযোগ পাচ্ছে না। তার আগেই এদের একটি বড় অংশ মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীরা দেরি করে হাসপাতালে আসায় তাদের মৃতু্যর হার বেশি।

তবে ভুক্তভোগীদের অনেকেই এ ব্যাপারে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, মডারেট রোগীরাও অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। বেসরকারি হাসপাতালের বিশাল ব্যয় বহন করার সামর্থ্য স্বল্প আয়ের মানুষের না থাকায় তাদের একটি বড় অংশ বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে। সরকারি চিকিৎসা সেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে ডেঙ্গু রোগীর মৃতু্যর হারে লাগাম টানা কঠিন হবে।

অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো না হলে ভুল ফ্লুইড ব্যবস্থাপনার কারণে রোগীর মৃতু্য বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন সরকারি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক। তাদের ভাষ্য, সরকারি হাসপাতালের শয্যা সংকটের সুযোগ নিয়ে বেসরকারি কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার নামে রীতিমতো ফাঁদ পেতে বসেছে। প্রয়োজন ছাড়াই রোগীকে স্যালাইন দিচ্ছে। এমনকি বিনা প্রয়োজনে পস্নাজমা দেওয়ারও নজির রয়েছে। ডেঙ্গুর ডেথ রিভিউ করা হলে এসব অসঙ্গতি ও অপচিকিৎসা সহজেই চিহ্নিত করা যেত।

তবে ডেঙ্গুর ডেথ রিভিউয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিরোধিতা করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এতে উপকারের চেয়ে বিভ্রান্তিই বেশি সৃষ্টি হবে। কোনো দেশ এই রিভিউ করে না। ডেথ রিভিউ কমিটি তখনই দরকার হয় যখন কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন আসে। যেহেতু দেশে রোগীর মৃতু্যতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না, তাই এ প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্বহীন।

এর আগে ২০১৯ সালে ডেথ রিভিউ কমিটি করা হলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। ডেঙ্গুতে মৃতু্যর তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি থেকে জনমনে আতঙ্ক বাড়ায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর'র 'ডেথ রিভিউ' প্রক্রিয়া বাতিল করার পরামর্শ দেন এ সংস্থারই সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, হাসপাতালে পরীক্ষা করে যেখানে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, চিকিৎসক যখন বলছেন রোগীর মৃতু্য হয়েছে ডেঙ্গুতে, সেটাই মেনে নিতে হবে। ওই তথ্যটুকুই যথেষ্ট।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অনেকের দাবি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কেউ যদি স্ট্রোকে মারা যায়, তাহলে বলতে হবে ডেঙ্গুতেই তার মৃতু্য হয়েছে। এটাই নিয়ম। হতে পারে তার আরও কিছু সমস্যা ছিল যা মৃতু্যর ক্ষেত্রে প্রভাবক হতে পারে। কিন্তু কেউ কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে সেটাই তার মৃতু্যর কারণ বলে ধরতে হয়।

আর এটা অস্বীকার করার উপায় নেই বলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে থাকে, কারও মধ্যে একাধিক প্রাণঘাতী রোগের লক্ষণ থাকলে তার মৃতু্যর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকিটা বেশি থাকে। এ কারণে তাদের মৃতু্যর হারও বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৯ হাজার ৪৮৩ জন রোগীর মধ্যে ৬৩.৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬.৪ শতাংশ নারী। এ হিসাবে আক্রান্তের দিক থেকে পুরুষ এগিয়ে থাকলেও নারীর মৃতু্যর হার বেশি। ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৩২৭ জন। এর মধ্যে ১৮৪ জন নারী এবং ১৪৩ জন পুরুষ। পুরুষের তুলনায় নারীর আক্রান্তের হার কম হলেও তাদের মৃতু্য কেন বেশি তার কারণ খোঁজা জরুরি বলে মনে করেন অনেকেই।

তবে নারীর চেয়ে পুরুষের আক্রান্ত বেশি হওয়া নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত টানার সুযোগ নেই বলে মনে করেন আইইডিসিআর'র উপদেষ্টা ডাক্তার মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, নারী-পুরুষ সবাইকেই মশা কামড়াচ্ছে। এমন হতে পারে নারীরা হাসপাতালে যাচ্ছে কম। পুরুষরা বেশি ভর্তি হচ্ছে। তবে নারীদের বেশি মৃতু্যর বিষয়টি ভাবনার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, 'এটা নিয়ে যদি জরিপ করা যায়, তাহলে ভালো হতো। তবে এখনো পর্যন্ত যেটা দেখা যাচ্ছে, নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন। নারীরা একটু ভালনারেবল বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একইভাবে শিশুরা এবং ষাটোর্ধরাও ডেঙ্গুতে ভালনারেবল গ্রম্নপ।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, মারা যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব না। তবে বাংলাদেশের নারীদের চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ কম। এটা কারণ হতে পারে।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, 'হেলথ সিকিং বিহেভিয়ারের যত স্টাডি আছে, তাতে দেখা যায় নারীরা চিকিৎসকের কাছে যায় দেরিতে, হাসপাতালে আসে দেরিতে। এছাড়া আর্থিকভাবেও নারীরা এত স্বাবলম্বী না। যে কারণে নারীদের চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টা পুরুষদের মতো না। নারীরা আক্রান্ত হলে গুরুত্ব দিচ্ছে না- এটা বেশি মৃতু্যর কারণ হতে পারে। কিন্তু আমরা ডেথ রিভিউ করার পরই মূল কারণটা বলতে পারব।'

পুরুষদের আক্রান্ত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, পুরুষদের মুভমেন্ট বেশি। তারা ব্যস্ত বেশি থাকে, ফলে অতটা সতর্ক থাকতে পারে না। যে কারণে মশার কামড়ও বেশি খেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছে এদের মধ্যে ৮০ শতাংশের মৃতু্য হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক থেকে তিন দিনের মধ্যেই। বাকিদের মধ্যে চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃতু্য হয়েছে ১৪ শতাংশের আর ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মৃতু্য হয়েছে বাকি ৬ শতাংশের।

ডেঙ্গুতে এবার মৃতু্য বেশি হওয়া প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, 'আমরা এখন মৃতু্যর কারণ অনুসন্ধান করছি। তবে এখন পর্যন্ত থাকা তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি, প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং তাদের মৃতু্য হয়েছে শক সিনড্রোমে। এছাড়া অন্য কারণেও হতে পারে। কিন্তু তার জন্য অটোপসি করা প্রয়োজন।'

দেশে রোগ নিয়ে গবেষণাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে- ডেন-১, ২, ৩ ও ৪। এবার এই চার ধরনের মধ্যে একাধিক ডেন থাকলেও চলতি বছরে ডেন দুই এবং তিনের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। গতবার যেটা ছিল তিন এবং চার। তবে একাধিক সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সিভিয়ারিটি বেশি হয় এবং যত বেশি সিভিয়াটি থাকে, তত মৃতু্যর ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে