সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৩

আহত অর্ধশতাধিক হ দুই তদন্ত কমিটি, লোকোমাস্টার-গার্ড বরখাস্ত হ স্বজনদের কান্নার রোল হ নিহতদের পরিবার পাচ্ছে ২৫ হাজার টাকা
ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি
  ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে সোমবার দুই ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কয়েকটি বগি। উদ্ধার কাজে অংশ নেন ফায়ার সার্ভিস,র্ যাব, পুলিশ ও স্থানীয়রা -যাযাদি

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসের দুটি বগি উল্টে অন্তত ২৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। সোমবার বিকাল পৌনে ৪টায় ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের আউটারে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনায় দু'টি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে এক লোকোমাস্টার (চালক), সহকারী লোকোমাস্টার ও গার্ডকে। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে 'সিগনালিং জটিলতা' বলে ধারণা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।

দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের সবার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে যাদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে তারা হলেন- ময়মনসিংহ নান্দাইল মেরেদা এলাকার জুনায়েদ মিয়ার স্ত্রী জোসনা বেগম, কুলিয়ারচর লক্ষ্ণীপুর গ্রামের মোহাম্মদ জিলস্নুর রহমানের ছেলে হুমায়ুন কবীর, বাজিতপুরের ভূইয়াগাও গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে আদির উদ্দিন, নরসিংদীর রাধানগর গ্রামের আগানগরের আব্দুল মান্নানের ছেলে আফজাল হোসেন, ভৈরব বাজার রানী বাজার প্রবোধ শীলেরর ছেলে সুজন সীল, ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের মানিক মিয়ার ছেলে রাব্বী মিয়া, কিশোরগঞ্জের চাঁনপুর গুপদিয়া গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে সায়মন মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল থানা মৃত সুরত আলীর ছেলে নিজাম উদ্দিন সরকার।

এদিকে, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ, কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজের তদারকি করেন। এ ছাড়া ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিকুর রহমান সবুজ, থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম, ভৈরব রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ আলিম সিকদার,র্ যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় শতাধিক সদস্য উদ্ধার কাজে অংশ নেন।

অন্যদিকে দুর্ঘটনায় আহতদের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেসহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও বাজিতপুর জুহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আহত অন্তত ২০ জনকে ঢাকাসহ অন্য স্থানে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করা হয়েছে।

ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি মো. আলিম হোসেন শিকদার সংবাদিকদের জানান, 'এ ঘটনায় অন্তত ২৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।'

র্

যাব-৯ এর এএসপি গোলাম মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনাস্থলের্ যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানতে পেরেছি।'

তবে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৬

আমরা ১৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছি।'

এদিকে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের সুপার আনোয়ার হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, 'মালবাহী ট্রেনটি এগারো সিন্ধুর ট্রেনের পেছনের দুটি বগিতে আঘাত করে। এতে অন্তত ১৭ জনের মৃতু্য হয়েছে।'

স্থানীয়রা জানান, মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল আর যাত্রীবাহী এগারো সিন্ধুর ট্রেনটি যাচ্ছিল ভৈরব থেকে ঢাকার দিকে। ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ দুই বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের দুটি বগি উল্টে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারকাজে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন।

বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের বর্ণনায় দুর্ঘটনা

বেঁচে যাওয়া যাত্রী পারুল বেগম জানান, আমি কিশোরগঞ্জ থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে উঠি। ভৈরব রেলস্টেশনে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার সময় ৩.১৫ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দে কাঁপতে কাঁপতে ট্রেনটি ঝাঁকুনি দিতে থাকে। এসময় আমি সিট থেকে পড়ে যাই। তারপর শুনতে পাই অন্য যাত্রীদের কান্না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কয়েকটি বগি কাত হয়ে রেললাইনের পাশে খাদে পড়ে গেছে। তখন আমি কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছি।

ট্রেনের আরেক যাত্রী মোশারফ হোসেন বলেন, ভৈরব থেকে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার পর আউটার সিগনালে গিয়ে লাইন ক্রস করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনটি হঠাৎ এগারো সিন্ধুর ট্রেনের পিছনের দিকে ধাক্কা দেয়। এসময় মালবাহী ট্রেনটির গতি ছিল অনেক বেশি এবং এগারো সিন্ধুর ট্রেনের গতি ছিল কম। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে এগারো সিন্ধুর ট্রেনের পিছনের চারটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে চুরমার হয়ে যায় এবং বগিগুলি উল্টে খাদে পড়ে। এসময় বগির যাত্রীরা চাকার নিচে পড়ে গিয়ে তারা নিহত ও আহত হয়।

সিগনালিং জটিলতায় দুর্ঘটনা

সিগনালিং জটিলতায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার। সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে তিনি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে একটি মালবাহী ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করছিল। তার আগ মুহূর্তে ভৈরব থেকে এগারো সিন্ধুর ট্রেন ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিল। জগন্নাথপুর রেল ক্রসিং এলাকায় এগারো সিন্ধুর ট্রেনের শেষের দু-তিনটি বগিতে কন্টেইনারবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন আঘাত করে। মূলত সিগনালিংয়ের কোনো জটিলতায় এমনটা ঘটেছে।

আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন

এ ঘটনায় বিভাগীয়ভাবে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার সিরাজ-উদ-দৌলা খান জানান, ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় রেলওয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ আলাদাভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ঢাকা বিভাগীয় তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিভাগীয় পরিবহণ কর্মকর্তা, বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লোকোমেটিভ, বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ এবং বিভাগীয় সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলী।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় তদন্ত কমিটিতে আছেন- রেলওয়ের সিওপিস মো. শহিদুল ইসলাম, চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জাকির হোসেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, আরমান হোসেন, সিএসপি তুষার ও চিফ মেডিকেল অফিসার আহাদ আলী সরকার।

ঢাকা বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে তিন কর্মদিবস এবং চট্টগ্রাম জোনের তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

লোকোমাস্টার-গার্ড বরখাস্ত

এ ঘটনায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের লোকোমাস্টার (চালক), সহকারী লোকোমাস্টার ও গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান।

নিখোঁজদের জন্য স্বজনদের কান্নার রোল

দুর্ঘটনাস্থলে হতাহতদের স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা গেছে। ট্রেনের কয়েকটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে নিচে চাপা পড়েন অনেকে। স্বজনরা খুঁজে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

শারদীয় দুর্গোৎসবে ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের ছাত্র আফজাল হোসেন (২২)। সোমবার বিকালে এগারো সিন্ধুর ট্রেনে রাজধানীতে ফেরার কথা ছিল। সে অনুযায়ী ট্রেনেও উঠেছিলেন। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনার পর এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত সাড়ে নয়টার দিকে তার খোঁজ পায়নি স্বজনরা। আফজালের বাড়ি ভৈরব উপজেলার রাধানগর গ্রামে।

ঘটনাস্থলে ছোটভাই আফজালকে খুঁজতে এসেছেন তার বড়ভাই রাসেল। তিনি বলেন, 'আমি শিক্ষকতা করি। ছোটভাই পূজার ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। আজ রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু সে ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে কোথায় এখন বলতে পারছি না।'

শুধু আফজাল নয়, অনেককেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।

নিহতদের পরিবার পাচ্ছে ২৫ হাজার টাকা

দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার প্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ। সোমবার রাত ৮টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি এ কথা জানান।

জেলা প্রশাসক বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ১৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছি। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের এখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার আছেন। যাদের উন্নত চিকিৎসা দরকার তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মরদেহ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

৪ ঘণ্টা পর দুর্ঘটনাস্থল ছেড়ে গেল মালবাহী ট্রেন

দুর্ঘটনার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর মালবাহী ট্রেনটি ঘটনাস্থল ছেড়ে গেছে। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ট্রেনটি দুর্ঘটনাস্থল ভৈরব জংশনের পার্শ্ববর্তী জগন্নাথপুর এলাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি জানান, ইতোমধ্যে মালবাহী ট্রেনটি স্টেশন ত্যাগ করেছে। উদ্ধারকারী ট্রেন এসেছে। যাত্রীবাহী ট্রেনটি উদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে