জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৮) প্রথম কয়েক দিনে বিভিন্ন খাতে ৫৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যে জলবায়ু সংক্রান্ত ক্ষয় ও ক্ষতিকে (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের শীর্ষ জলবায়ু কর্মকর্তা সাইমন ইমানুয়েল কারভিন স্টিয়েল বলেছেন, এ ব্যাপারে তহবিলে অর্থায়নসহ আমাদের সামনের দিকে এগোতেই হবে। এখান থেকে পেছন ফেরার সুযোগ নেই। উন্নত দেশগুলো বেশ কয়েক বছর আগে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গরিব দেশগুলোকে তাদের অভিযোজন ও সবুজ জ্বালানির উন্নয়নে এই অর্থ দেওয়া হবে। আশা করছি, এ বছর আমরা এই প্রতিশ্রম্নতির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব।
এদিকে, কপ-২৮ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কপ-২৮ এ পর্যন্ত ৫৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছে। সরকার, ব্যবসা, বিনিয়োগকারী এবং সমাজসেবীরা কপ-২৮-এর প্রথম পাঁচ দিনে ঐতিহাসিক আটটি অঙ্গীকার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থ, স্বাস্থ্য, খাদ্য, প্রকৃতি এবং শক্তিসহ সমগ্র জলবায়ু এজেন্ডা জুড়ে ঘোষণাগুলো বিশ্বব্যাপী সংহতির শক্তি প্রদর্শন করে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইউএই এবং বিশ্বদাতারা অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগকে পরাস্ত করতে এবং ১৬০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি করতে ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে।
এবারের সম্মেলনে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য শুরু থেকেই তহবিল অনুমোদন করেছে তেলের অন্যতম বড় উৎপাদক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উন্নত আরও কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকেও এমন সহায়তার আশ্বাস এসেছে। এসব দেশগুলো প্রথম দিনেই ৪২ কোটির বেশি ডলার তহবিল ভুক্তভোগী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য
\হবরাদ্দের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে দেশটি। এছাড়া যুক্তরাজ্য ৬ কোটি পাউন্ড, যুক্তরাষ্ট্র ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার ও জাপান ১ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) ২৪ কোটি ৫৩৯ লাখ ডলার এবং জার্মানি ১০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে।
এই সম্মেলনে ভাষণ দেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। তিনি বলেছেন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে উত্তরণের চেষ্টায় টোকিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। কিশিদা আরও বলেছেন, নতুন কয়লা-চালিত বিদু্যৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি জাপান বাতিল করে দেবে। তবে কবে থেকে এটা কার্যকর করা হবে এবং চলমান কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য কিছুই উলেস্নখ করেননি।
এর আগে ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এ জন্য জাপানকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছে। বিবৃতিতে কপ কর্তৃপক্ষ উলেস্নখ করেছে, এশিয়া মহাদেশজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি তিন গুণ বৃদ্ধি করে নেওয়ার বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন জাপান কঠিন করে তুলছে। উলেস্নখ্য, এশিয়ার অনেক দেশেই কয়লা ব্যবহার করে বিদু্যৎ উৎপাদনে জাপান এখনো সহায়তা প্রদান করে আসছে। জাপানের একটি পরিবেশ সংগঠন এফওই জাপানের প্রতিনিধি হিরোকি ওসাদা জাপানের পক্ষ থেকে 'ফসিল অব দ্য ডে' পুরস্কার গ্রহণ করেন। তিনি বলেছেন, এশিয়া মহাদেশ জুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ধারণা কার্যকর করায় জাপানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও জীবাশ্ম জ্বালানি মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় অবশিষ্ট বিশ্বের চাইতে টোকিও অনেক পেছনে পড়ে আছে। তিনি আশা করছেন, যত দ্রম্নত সম্ভব জাপান এই নীতি পরিবর্তন করবে।
দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বেশ। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কাজ করলেও তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা তাদের জন্য বিধিবিধান তৈরি হওয়ার আগে বিতর্কিত কার্বন ক্রেডিট হাইপিং ঘোষণায় পরিবেশবাদী দলগুলো ব্যাপক আকারে 'গ্রিন ওয়াশিং'-এর আশঙ্কা করছে। ক্রেডিটগুলোর পেছনের ধারণাটি সম্প্রতি একটি বড় আঘাত নিয়েছে, কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বারবার দেখানো হয়েছে, স্কিমগুলোর অধীনে কার্বন নির্গমন হ্রাসের দাবিগুলো প্রায়ই ব্যাপকভাবে অত্যধিক মূল্যায়ন করা হয়। কার্বন ক্রেডিট করপোরেশনগুলোকে অনুমতি দেওয়া হয় কিছু শর্তের অধীনে দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করতে।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ নভেম্বর থেকে জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে। যা চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৭৬০ সালের পর ইউরোপে যখন শিল্পবিপস্নবের সূচনা হয় তখন থেকেই প্রকৃতির বিপদের শুরু। তখন থেকেই পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়। এর ফলে দিন দিন বাতাসের উষ্ণতা বেড়েছে, হয়েছে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ১ দশমিক ৬২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে একবিংশ শতাব্দী শেষে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় অর্ধশত দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা, খরা, দাবানল বেশি হচ্ছে। এ কারণে এবারের জলবায়ু সম্মেলনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।