বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের খবর কী

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের খবর কী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে প্রায় তিন মাস। কিন্তু নির্বাচনের ১৭ দিন আগে বিএনপির ডাকা অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে এখনো জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। কৌতূহলীরা জানতে চান, সমাপ্তির ঘোষণা না আসা এই কর্মসূচি কি এখনো চলছে? এ ব্যাপারে বিএনপি নেতারা কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যায়যায়দিনকে বলেন, তারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আছেন। এই আন্দোলন সফলে সময়ের প্রয়োজনে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। অসহযোগও এরই একটি, যা নির্বাচনের সময়ে চলেছে। ভোট বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ এই কর্মসূচি সফল করেছেন। আর অন্য যেসব আহ্বান ছিল তা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের কারণে দৃশ্যমান হয়নি। তবে আন্দোলনের গতি খুব শিগগিরই বৃদ্ধি পাবে। তখন সেই বাকি আহ্বানে মানুষের সাড়া দেওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হবে। এর মধ্য দিয়েইে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধানের আন্দোলন সফল হবে।

কোনো ঘোষণা ছাড়াই অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে- এই তথ্য কি সঠিক- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সময়ের প্রয়োজনে তা চলে এবং স্থগিতও হয়।

সূত্রমতে, মামলা-হামলার পাশাপাশি দায়িত্বশীল নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন এক পর্যায়ে বিএনপির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন থেকে পিছু হটারও কোনো উপায় ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে জনগণের উদ্দেশে একগুচ্ছ আহ্বান রেখে অসহযোগের কর্মসূচি দেয় দলটি। যদিও নীতি নির্ধারণী ফোরামের অনেক নেতাই এই কর্মসূচিতে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির অভ্যন্তরের কোন্দল, সাংগঠনিক বেহাল অবস্থা ও দলের সমন্বয়হীনতার গল্প এই অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির কারণ

হিসেবে দলীয় পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, দেড় মাসেরও বেশি সময়ের হরতাল অবরোধের কর্মসূচিতে সারাদেশে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সাধ্যমতো রাজপথে থাকার চেষ্টা করলেও দায়িত্বশীল নেতাদের অনেকেরই খোঁজ ছিল না। এছাড়া এর আগের নির্বাচনে দলের ছয় শতাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দায়িত্বশীল কিছু নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। দলের সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিক নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনা হলেও আরও বেশকিছু জটিলতা তৈরি হয়। কারাগারের বাইরে থাকা নেতাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া হাইকমান্ডের সঙ্গে কেউ যোগোযোগ করেননি। ফলে হাইকমান্ডকে বিদেশে থাকা কয়েকজন নেতাকে দিয়ে আন্দোলন সমন্বয় করতে হয়েছে। কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের নেতাদের বেশির ভাগই মোবাইল বন্ধ করে আত্মগোপনে ছিলেন। সবমিলে ভার্চুয়ালি কিছু নেতার সঙ্গে হাইকমান্ডের যোগাযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া শীর্ষ নেতৃত্ব আন্দোলনের 'একচুয়াল' অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। সেই সময়ের আন্দোলনের করুণ অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত না থাকার কারণে একরকম বাধ্য হয়েইে ঘোষণা করা হয় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি। গত ২০ ডিসেম্বর এক ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল ভোট বর্জন, ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া, ভোট গ্রহণে নিযুক্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে সব ধরনের কর (ট্যাক্স), খাজনা, পানি, বিদু্যৎ, গ্যাস বিল দেওয়া স্থগিত রাখা, ব্যাংকে টাকা না রাখা, আদালতে মামলায় হাজিরা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরত থাকা ইত্যাদি।

এই কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই পরিস্থ্থিতি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আন্দোলন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যেকোনো উপায়ে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় খোঁজা হচ্ছিল। এরই অংশ হিসেবে জনগণের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে এটি ছিল একটি হটকারী সিদ্ধান্ত। 'অসহযোগ'-এর মতো একটি সর্বাত্মক ও কষ্টসাধ্য আন্দোলন-কর্মসূচি ঘোষণার আগে দুবার ভাবা উচিত ছিল।

এই কর্মসূচি নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে এই নেতা আরও বলেন, এ কর্মসূচি সফল করার কোনো ক্ষমতাই বিএনপির ছিল না। তারপরও হাইকমান্ড কেন এ ধরনের কর্মসূচি দিলেন তা এখনো অনেকে বুঝে উঠতে পারেননি। বলা হলো, খাজনা-ট্যাক্স না দিতে, ব্যাংকে টাকা না রাখতে, গ্যাস-বিদু্যৎ-পানির বিল না দিতে। কিন্তু একবারও ভাবা হয়নি যারা ব্যবসা করেন তারা ব্যাংকে লেনদেন না করে কী করবেন এর বিকল্প কী? আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ীরা কি কাস্টমস ডিউটি না দিয়ে পারবেন? গ্যাস-পানি-বিদু্যৎ অনেক জায়গায় প্রিপেইড মিটারে চলে। কার্ডের টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার পরে কার্ড রিচার্জ না করে থাকা কি সম্ভব? সবমিলে এটি ছিল এক ধরনের উদ্ভট কর্মসূচি।

অসহযোগে ব্যর্থ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। বিএনপিতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নিজের পছন্দ ও বিশ্বস্ত নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করেন তিনি। ফলে হঠাৎ সাংগঠনিক কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন এমন অনেক ত্যাগী ও সিনিয়র নেতা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বাদ পড়ে যান। তারেক রহমান যাদের নেতৃত্বে আনেন তাদের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে যোগ্য ও দক্ষ নন বলে দলে অভিযোগ আছে। অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের কারণে আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরীতে আন্দোলন সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারেক বলয়ের নেতারা। আমান উলস্নাহ আমান কারাগারে যাওয়ায় চিকিৎসক নেতা ফরহাদ হালিম ডোনারকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ তিনি কখনো ঢাকা মহানগরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে আন্দোলন সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা সাবেক ছাত্রনেতা রকিবুল ইসলাম বকুল। যাকে দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকে মেনে নেননি। অন্যদিকে আন্দোলনের সময় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত দল এবং দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ে যোগাযোগ রাখতেন ভারতে অবস্থানরত স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রায় ৯ বছর দেশের বাইরে থাকা এই নেতা আন্দোলন সমন্বয়ের দায়িত্বে পেলেও স্থানীয় পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র তার কাছে ছিল না। ফলে আন্দোলন যেমন গতিশীল হয়নি।' তেমনি স্থানীয় ত্যাগী নেতারা আন্দোলনে সহযোগিতা করেননি বললেই চলে। ফলে আন্দোলন নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না। এজন্য জনগণের কাছে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে বিএনপি নেতৃত্ব।

দেশে এখনো অসহযোগ আন্দোলন চলছে কিনা-এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব নেই শরিক দলগুলোর নেতাদের কাছেও। এ বিষয়ে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ৭ জানুয়াররি আগে ভোট বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ অসহযোগের কর্মসূচি সফল করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের মারমুখী অবস্থানের কারণে অবশ্য কিছু কিছু আহ্বানে জনগণ সাড়া দিতে পারেনি। তবে অসহযোগের কর্মসূচি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ভারতের পণ্য বর্জনের যে আহ্বান করা হয়েছে তা অসহযোগেরই অংশ।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, এই আন্দোলন এখনো চলছে কিনা না, নাকি শেষ হয়েছে তা তার জানা নেই। দীর্ঘ মেয়াদের আন্দোলনের কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনতে হয়তো এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। তবে এটি একটি অপরিপক্ব কমসূচি ছিল। পাশাপাশি সমন্বয়হীনতা ও দিকনির্দেশনার ব্যাপক ঘাটতি ছিল।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএসএমএমইউ'র সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক ডা. শহীদুলস্নাহ সিকদার বলেন, যুগে যুগে অহযোগ আন্দোলন কার্যকর হওয়ার ইতিহাস আছে। এর অন্যতম কারণ ছিল নির্দিষ্ট দাবির পক্ষে আন্দোলনে জনগণের এক ধরনের প্রস্তুতি ছিল। মহত্না গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বা বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এক দাবির পক্ষে সব মানুষের সমর্থন নেই। আছে বিভক্তি। সঙ্গত কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলনকে বাস্তবমুখী কর্মসূচি বলা যাবে না। এজন্যই হয়তো এর স্থায়িত্ব নিয়ে মতপার্থক্যের রাজনৈতিক কৌশল আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে