শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন

কষ্টের গ্রামেও সুখের ছোঁয়া

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
কষ্টের গ্রামেও সুখের ছোঁয়া

ধানসহ অন্যান্য ফসলের বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সার-বীজ-কীটনাশকের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে বিপাকে পড়েছেন অধিকাংশ কৃষক। এর ওপর সব ধরনের নিত্যপণ্যের চড়া দরসহ নানামুখী সংকট 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ঈদের আগমুহূর্তে শহরে চাকরিজীবী স্বজনদের বেতন-বোনাস ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বেশখানিকটা সচ্ছলতা ফিরেছে গ্রামে। এর ওপর দীর্ঘদিন পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাড়ির টানে স্বজনরা ঘরে ফেরায় সুখের হাসি ফুটেছে গ্রামীণ জনপদে।

এদিকে রোজা শুরুর পর থেকে গ্রাম ও মফস্বল শহরের হাট-বাজার ও মার্কেটসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনায় চরম মন্দা ভাব দেখা দিলেও সে কালো মেঘ যেন কেটে গেছে হঠাৎ দমকা ঝড়ে। শহুরে চাকরিজীবীরা গ্রামে

ফিরে বাবা-মা-ভাই-বোনদের পাশাপাশি নিকটাত্মীয়-স্বজনদের জন্য জামা-কাপড়-শাড়ি-জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ও নানা ব্যবহার্য সামগ্রী কিনতে শুরু করায় ভিড় বেড়েছে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে মন্দার আশঙ্কায় গুটিয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের মুখেও ফিরেছে সন্তুষ্টির হাসি।

এদিকে ঋণের টাকা শুধতে কম দামে উৎপাদিত ফসল বেচে দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা অনেক কৃষকই শহর থেকে ঘরে ফেরা চাকরিজীবী সন্তানদের কাছ থেকে নগদ টাকা পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ঈদের বাড়তি বাজেট কিছুটা কাঁটছাঁট করে তারা অনেকেই সুদি মহাজনের ঋণের টাকা শুধেছেন। এতে ঋণের বোঝার বিশাল চাপ কমেছে অনেকের।

আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান, ঈদের জন্য রং-বেরঙের জামা-কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি ও নানা ধরনের ইমিটেশনের গহনাসহ বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে দোকানিরা এতদিন ক্রেতাশূন্য দোকানে হতাশায় দিন কাটালেও সে চিত্র কয়েকদিনে পুরোপুরিই পাল্টেছে। আর্থিক সংকট পুরোপুরি না কাটলেও দরিদ্র কৃষকরা দোকানে দোকানে ঘুরছে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে। স্বাধ আর সাধ্যির সমন্বয় করে আবদার মেটাচ্ছেন সন্তানের।

কৃষকরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আর্থিক কষ্ট তাদের রয়েই গেছে। তবে তা খানিক চাপা রেখেই স্বজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাইছেন অনেকেই। চাকরিজীবী সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া নগদ টাকায় মহাজনের ঋণ কিছুটা শুধতে পারায় তারা এখন বেশখানিকটা ফুরফুরে। কেননা আর্থিক টানাটানি কিছুটা ঘুচে যাওয়ায় ক্ষেতে উৎপাদনকৃত ফসল বেচতে পারবে কিছুটা রয়ে সয়ে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, শেকড়ের টানে শহরের কর্মজীবী মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করায় ক'দিন আগে থেকেই ঈদ আনন্দে মেতেছে গ্রাম। নিখাদ এ আনন্দের ঝলকানিতে আলোকিত পলস্নী বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে। গ্রামের পথে পথে, হাটবাজারে ঈদের খুশি ছড়িয়ে নিঃস্বার্থ ভালোলাগাকে আরও নিবিড় করে তুলছে প্রবাসী মানুষ। মা-বাবা, ভাই-বোন আর পুরান সাথীরা বহুদিন পর একসাথে হয়ে মেলে ধরেছে স্মৃতির ডালা। নগরজীবনের নানা দুর্ভোগ আর বুকে চাপা সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছে সবাই। দুই হাত খুলে খরচ করছেন গ্রামে ফেরা লোকজন। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ নিকটাত্মীয়-স্বজনদের জন্য যারা শহর থেকে ঈদ উপহার কিনে নিয়ে যেতে পারেননি তারা গ্রামের দোকানপাট থেকেই কেনাকাটা করছেন। তাই দোকানে দোকানে পড়েছে বেচাকেনার ধুম। তবে মূল্যবান জিনিসপত্রের কেনাকাটা না বাড়লেও সামর্থ্যের গন্ডিতে বাধা স্বল্পদামি উপঢৌকন পেয়েই উচ্ছ্বসিত গ্রামে থাকা স্বজন। ছয় থেকে সাতশ' টাকায় কেনা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আর মোটা জমিনের শাড়ি পেয়ে আনন্দে অশ্রম্ন সজল বাবা-মায়ের চোখ।

মানুষের ভিড় গ্রামে যতই বাড়ছে, ততই প্রাণ ফিরে পাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া ঈদে ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের কারণে গ্রামে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে অনেক বেশি। জাকাত ও ফেতরার বড় অংশ বিতরণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে। যা গ্রামের মানুষের জন্য ইতিবাচক হয়ে ধরা দিয়েছে।

এদিকে বছর ঘুরে ঈদে ছেলে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনি আসার পর তাদের পছন্দের কোনো খাবার রান্না এবং শহরে ফেরার সময় চিড়া-মুড়ি-নাড়ু সঙ্গে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে যেন গোটা গ্রামীণ জনপদ জুড়ে। এর সঙ্গে চলছে ঈদের প্রস্তুতি। তাই প্রতিটি ঘরেই কর্মচাঞ্চল্য, অবসর নেই কারো। তবে এসব কাজে যেন কারো কোনো কষ্ট নেই, নেই কোনো ক্লান্তি। ছোট বড় সবার কাছেই এসব কর্মচাঞ্চল্য যেন ধরা দিয়েছে আনন্দ উৎসবের অংশ হয়েই।

ঈদের ছুটিতে ক'দিন আগেই যারা ঘরে ফিরেছেন তাদেরও অবসর নেই। ঈদের ছুটি ক'দিন পরই ফুরিয়ে যাবে, আবারও ফিরে যেতে হবে সেই ইট-পাথরে গড়া পাষাণ নগরে। তাই এরই মাঝে পাওয়া সময়ের একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চায় না শহর থেকে ফেরা মানুষ। ভোর না হতেই তাই কেউ বা ছুটছে দূর গ্রামে থাকা নিকটাত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি। হাতে রয়েছে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য শহর থেকে আনা ঈদ উপহার। আর এসব হাতে পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী যারা এখনও গ্রামে ফিরতে পারেনি, ওইসব পরিবার প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে প্রিয়জনদের ঘরে ফেরার পথ চেয়ে। তাদের থাকা-খাওয়ার আগাম বন্দোবস্তে ব্যস্ত সময় কাটছে তাদেরও। যারা শেষ সময়ে গ্রামে ফিরবেন, তাদের অধিকাংশই গ্রামে থাকা স্বজনদের জন্য ঈদ কেনাকাটার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই এসব পরিবারেও বইছে আনন্দের জোয়ার।

প্রায় এক বছর পর রোববার সকালে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন রংপুরের নির্মাণ শ্রমিক রহমতুলস্নাহ। মা, ছোট বোন, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের ছেলের জন্য সঙ্গে নিয়েছেন নতুন পোশাক। আছে বেশ কিছু নগদ টাকাও। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে বাসে চড়েই গ্রামে ফিরেছেন তিনি। তবে দীর্ঘ পথের ভোগান্তির কোনো শঙ্কা নেই তার চোখেমুখে। রহমতুলস্নাহর চোখে এখন শুধুই শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে খোঁজার প্রত্যাশা। আর বাবা-মা ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রতীক্ষা।

ফরিদপুরে যাওয়ার জন্য রোববার সকালে ঢাকার মালিবাগের সোহাগ কাউন্টারে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ গার্মেন্টস কর্মী শেফালি জানান, ঈদ খরচার জন্য ছয় মাস ধরে বেতনের টাকা থেকে ৫/৭শ' করে টাকা জমিয়েছিলেন। সে টাকা দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য লুঙ্গি-পাঞ্জাবি এবং দুই বছরের ভাতিজার জন্য ২০০ টাকা দিয়ে খেলনা কিনেছেন। নিজের জন্যও কিনেছেন বালুচুড়ি শাড়ি। শেফালি জানান, কিছু না নিয়ে গেলেও বাবা-মা-ভাইবোনেরা খুশি। তারপরও ঈদের সময় তাদের জন্য কিছু না আনলে ভালো লাগে না। তাই কষ্টের জমানো টাকায় এসব কিনেছেন। ছুটির এ ক'দিন পরিবারের সবার সঙ্গে কতটা আনন্দে দিন কাটবে তা বলতে গিয়ে আনন্দ অশ্রম্ন এসে যায় আলেয়ার দুই চোখে।

আমাদের সংবাদদাতারা জানান, সরকারিভাবে ঈদের ছুটি শুরু না হলেও শহরের কর্মস্থল থেকে আগেই বাড়ি ফিরে গেছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার নিজে কর্মস্থলে থাকলেও স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন ক'দিন আগেই। ফলে অধিকাংশ গ্রামে বয়ে যাচ্ছে ঈদের আগাম আনন্দ। নিখাদ এ আনন্দের ঝলকানিতে রাতের আঁধারেও ফুটেছে রঙিন আলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে