রাশিয়ার উত্তর ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের দুটি শহরে ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের চারটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালিয়েছে একদল বন্দুকধারী। একইসঙ্গে পুলিশের একটি তলস্নাশি চৌকিতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ২৩ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৫ জন পুলিশ সদস্য এবং ছয়জন হামলাকারী রয়েছে বলে জানা গেছে। হামলায় অন্তত এক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন। রোববার দাগেস্তানের সবচেয়ে বড় শহর মাখাচকালা এবং দেরবেন্ত শহরে হামলার এসব ঘটনা ঘটে। শেষ খবর পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেনি। তথ্যসূত্র : বিবিসি
কর্তৃপক্ষ বলছে, হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অতীতে দাগেস্তানে ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার নজির রয়েছে। আর এমন এক সময় এসব হামলার ঘটনা ঘটল, যখন দেরবেন্ত এবং মাখাচকালা শহরে গির্জায় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব পেন্টেকস্ট চলছিল। বন্দুকধারীরা দুটি গির্জা এবং দুটি সিনাগগকে লক্ষ্য করে আকস্মিক হামলা চালায়। এতে মাখাচকালার একটি গির্জায় একজন ধর্মযাজকও নিহত হয়েছেন। হামলার এই ঘটনাকে 'সন্ত্রাসী কর্মকান্ড' আখ্যা দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে রুশ প্রশাসন।
এদিকে হামলার পর ঘটনাস্থলের বেশকিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বেশ কয়েকটি ভবনে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মাখাচকালা শহরের একটি ভিডিওতে কালো পোশাক পরা কয়েকজন ব্যক্তিকে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
ঘটনার পর জরুরি সেবা সংস্থার সদস্যরা দ্রম্নত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। বন্দুকধারীদের হামলায় ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের নেতা সের্গেই মেলিকভ। অন্যদিকে হামলায় অংশগ্রহণকারী ছয় ব্যক্তি নিহত হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
দাগেস্তানের দেরবেন্ত শহর ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষের একটি প্রাচীন আবাসস্থল। বন্দুকধারীরা সেখানকার একটি সিনাগগ এবং একটি গির্জায় হামলা চালায়। হামলার পর উপাসনালয়গুলোতে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'টেলিগ্রামের' একটি বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, দেরবেন্তের একটি ভবনে বন্দুকধারীদের
কয়েকজনকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। এ ছাড়া মাখাচকালা শহরের নিকটবর্তী সার্গোকালিনস্কি জেলার প্রধান মাগোমেদ ওমরভকে পুলিশ আটক করেছে। রোববারের হামলার ঘটনার সঙ্গে তার দুই ছেলের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাশিয়ার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে দাগেস্তান অন্যতম। এটি রাশিয়ার মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোরও একটি। এর আগে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে 'ককেশাস আমিরাত' নামের একটি ইসলামপন্থি সশস্ত্র সংগঠন দাগেস্তান এবং এর পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি রুশ প্রজাতন্ত্রে হামলা চালায়। সংগঠনটি পরে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে 'ইসলামিক আমিরাত অব দ্য ককেশাস' রাখে।
এর আগে, মার্চে মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলের একটি কনসার্টে হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনার জন্য মস্কো ইউক্রেনকে দোষারোপ করলেও পরে হামলার দায় স্বীকার করেছিল সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-আইএস।
এরপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন জোর দিয়ে বলেছিলেন, রাশিয়া ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না। মূলত এরপরই হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে জোরালোভাবে অভিযান শুরু করে রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। পরে মস্কো হামলায় জড়িত সন্দেহে গত এপ্রিলে দাগেস্তান থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল রুশ গোয়েন্দারা।
রাশিয়া কেন হামলার লক্ষ্যবস্তু?
আইএস-কে যে রাশিয়ায় হামলা চালিয়েছে, এর পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আইএস-কে কয়েকটি রাষ্ট্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইসরাইল এবং ইহুদি, খ্রিষ্টান, শিয়া মুসলিম, তালেবান এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সব শাসককে শত্রম্ন হিসেবে গণ্য করে।
মূলত তারা যাদের 'ধর্মত্যাগী' মনে করে, তারাই তাদের শত্রম্ন। আর সে তালিকায় প্রথমদিকেই রয়েছে রাশিয়া।
রাশিয়ার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের শত্রম্নতা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সালের প্রথম দিকে চেচনিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মস্কোর সেনারা তখন চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিকে রীতিমত ধ্বংস করে দিয়েছিল। সবশেষ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সঙ্গেও নিজেদের জড়িয়েছে রাশিয়া। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করছে রুশ সেনারা।
রুশ বিমান বাহিনীর সদস্যরা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অবস্থানকে লক্ষ্য করে অগণিত বোমা হামলা চালায়। এভাবে ইসলামিক স্টেট গ্রম্নপ এবং আল-কায়েদার বিপুলসংখ্যক যোদ্ধাকে তারা হত্যা করে।
আইএস-কে আফগানিস্তানে রাশিয়াকে তালেবানের মিত্র হিসেবে দেখে। মূলত এ কারণেই তারা ২০২২ সালে কাবুলে রুশ দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিল।
এ ছাড়া ১৯৭৯-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর তৎকালীন সোভিয়েত সৈন্যরা যেভাবে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব চালিয়েছিল, সেটি নিয়েও আইএস-কে'র মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
আইএস-কে রাশিয়াকে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। মস্কো হামলার পর পোস্ট করা ভিডিওতে তারা খ্রিষ্টানদের হত্যার কথা উলেস্নখ করেছে।
তাজিকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মাঝে মধ্যেই রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) সদস্যদের হাতে হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। সেই রাশিয়াকে এখন আইএস-কে তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে থাকায় সহজেই দেশটিতে অস্ত্র পাওয়া যায় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব একটা জোরাল ছিল না।