একাত্তরের আরও একটি সংগ্রামমুখর দিন ১০ মার্চ। এই দিন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ বাংলার বিদ্রোহ-বিক্ষোভের তরঙ্গ। সংগ্রামী জনতা স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত নতুন পতাকা পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে উড়িয়ে বিক্ষোভে শামিল হন।
১০ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসেও উত্তোলিত হয় কালো পতাকা।
একাত্তরের এই দিন সকালে শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ বাসভবনে একদল বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে তিনি বলেন, 'সাত কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোনো মূল্যে তারা অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চাই।'
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী '৭১ এর দশ মাস' বইয়ে এই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে উলেস্নখ করেছেন, এই দিন বিকালে ওয়ালী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এছাড়া 'লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের' ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এই দিন সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসের কর্মচারীরা দশম দিনের মতো কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। জরুরি কাজের বিবেচনায় বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসা কেন্দ্র খোলা থাকে।
ইত্তেফাক পত্রিকায় ১১ মার্চ পত্রিকায় ১০ মার্চের প্রধান খবরগুলো প্রকাশ করা হয়। নতুন করে কারা প্রতিরোধে শামিল হলো সেটাও উলেস্নখ ছিল খবরে। সংবাদে বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের যুক্তবিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমানবন্দরে চেকপোস্ট বসিয়ে অবাঙালিদের দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার হুমকি নিয়েও সংবাদ প্রকাশিত হয়।
শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের জনগণের নামে আমি যে নির্দেশ দিয়েছি সচিবালয়সহ সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরগুলোতে তা পালিত হচ্ছে। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত।'
নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করেন। তারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বন্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে মহাসচিব উ-থান্টের কাছে স্মারকলিপি দেন। এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
এই দিন করাচিতে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান সাংবাদিকদের জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকায় যাবেন। ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায় সে জন্য আগে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করবেন। করাচি থেকে শেখ মুজিবকে টেলিগ্রাম/টেলিফোন বার্তায় আপসে বসার আহ্বান জানান এয়ার মার্শাল আসগর খান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে; সেনানিবাস পাকিস্তানের পতাকার মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ।
একাত্তরের ১০ মার্চ জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে 'চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যে কোনো সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নের সংকল্প জানায় পরিষদ।
এই দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্র নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর করলে চট্টগ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দিন যতই সামনে এগোচ্ছিল, মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধীনতার প্রশ্নে ততই উজ্জীবিত ও সংগঠিত হচ্ছিল। কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ, অবিচারের শিকার বাঙালির সামনে তখন মুক্তির পথে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
বস্তুত সাতই মার্চের ভাষণের পর থেকে সব কিছু চলতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশে। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ওই বক্তব্য বারবার প্রচার ও সম্প্রচার হতে থাকে, যা সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করেনি, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অদম্য শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে।
তথ্যসূত্র: '৭১ এর দশ মাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা।