গ্রীষ্মের এই অসহনীয় গরম থেকে স্বস্তিতে রাখতে আপনার আদরের সোনামণির প্রতি নিয়মিত যত্নের পাশাপাশি একটু বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। গ্রীষ্মকালীন নানারকম রোগবালাই'র পাশাপাশি পরিবেশের রূঢ় প্রভাব শিশু ও নবজাতকের জন্য অনেক কষ্টদায়ক। শিশুরা যেহেতু বড়দের মতো ওদের কষ্টগুলো বোঝাতে পারে না সেহেতু এই গরমে সঠিক, মনোযোগী ও শিশুদের জন্য আরামদায়ক যত্ন তাদের বেড়ে ওঠা ও আনন্দময় জীবন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
শিশুরা গ্রীষ্মকালীন রোগমুক্ত থাকুক
বছরের উষ্ণতম এই ঋতুতে শিশুরা সাধারণত ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ, ভাইরাল জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। গরমে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইটজনিত রোগ বাড়ে। কারণ তাপমাত্রার সঙ্গে এগুলোর সংক্রমণ বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া এই সময় চিকেন পক্স, রুবেলা, মাম্পস, স্ক্যাবিস বা খোঁসপাচড়া ইত্যাদি রোগীর সংক্রমণ বেড়ে যায়। সংক্রমণজনিত ছোঁয়াচে রোগ ছাড়াও শরীর থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় ঘাম বেরিয়ে যাওয়ায় তীব্র গরমে শিশুরা হিটস্ট্রোকেও আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া গরমে অনেক শিশুর ঘামাচিও দেখা দেয়। শিশু ও নবজাতকরা যাতে এই ধরনের রোগবালাইতে আক্রান্ত না হয়, তাই বাবা-মায়েদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
শিশুকে সূর্যের আলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন
শিশুরা ঘরের বাইরে যেতে বা খেলাধুলা করতে পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, গরমের সময় শিশুদের নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ালে তাদের খুব সহজেই হিটস্ট্রোক বা ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে জন্য শিশুদের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে। বয়স্ক শিশুদেরও গ্রীষ্মকালীন রোদ থেকে দূরে রাখতে হবে, বিশেষ করে বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সময়ে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুদের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেজন্য শিশুদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় ছাতা, সানস্ক্রিন ও সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা দিবে এমন পোশাক পরানো উচিত।
নিরাপদ পানি ও খাবার খেতে দিন
শরীরে যাতে পানিশূন্যতা দেখা না দেয়, তাই গরমের সময় নিরাপদ পানি ও তরল খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ ঘনঘন পান করাতে হবে। যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার গ্রহণ করছে, তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি ও পানি জাতীয় তরল খাবার খাওয়াতে হবে। বয়স্ক শিশুদের এ সময় ফল, ফলের শরবত, সালাদ ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে। যেমন, তরমুজ, শসা ইত্যাদি। এছাড়া গরমে অতিরিক্ত ঘামের জন্য লবণের ঘাটতি পূরণে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শিশুর দুর্বলতা কাটাতে মাঝেমধ্যে তাকে খাওয়ার স্যালাইন খেতে দেওয়া যেতে পারে।
শিশুকে সুষম খাবার খেতে দিন
শিশুরা যেন বাইরের খাবার না খায়, বাবা-মাকে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। বাইরের ফুচকা, চটপটি কিংবা ফাস্টফুড খেলে সেখান থেকে ডায়রিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ সময় শিশুদের বাড়িতে তৈরি ফ্রেশ খাবার খাওয়াতে হবে। শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তার খাদ্যতালিকায় সব ধরনের খাদ্য উপাদান সঠিক পরিমাণে থাকা জরুরি। মৌসুমি ফলমূলের পাশাপাশি সহজে হজমযোগ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াতে হবে। গরমের সময় এমনিতেই শিশুরা খেতে চায় না। সেজন্য প্রতিদিন বৈচিত্র্যময় খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই ধরনের খাবার প্রতিদিন খাওয়ানো হলে, খাবারের ওপর অনীহা চলে আসতে পারে। বাবা-মাকে ধৈর্য ধরে নতুন নতুন উপায়ে তাদের সন্তানকে বৈচিত্র্যময় খাবার খাওয়াতে হবে। আইসক্রিম, চকোলেট ইত্যাদি খেতে দেওয়া যাবে না। তাতে দেহে পানিশূন্যতা বেড়ে যেতে পারে।
ঘরের পরিবেশ আরামদায়ক করুন
গরমের সময় ঘরে প্রাকৃতিকভাবে আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য দিনের বেলা সকালে যখন রোদ উঠে, তখন ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ ঘরের বাতাসের চেয়ে বাইরের বাতাস বেশি গরম। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সন্ধ্যার সময় আবার ঘরের জানালা দরজা খুলে দিতে হবে। ঘরের বিভিন্ন কোণে গামলা বা বালতিতে পানি রেখে দিলে ঘরের তাপমাত্রা কমে যায়। বাথরুম ও রান্নাঘরে এক্সস্ট ফ্যান ব্যবহার করা উচিত। তাহলে তাপমাত্রা বাড়তে পারে না।
শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন
গরমকালে শিশুর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা জরুরি। এ সময় তাদের নিয়মিত প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করাতে হবে। ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। ধুলাবালি থেকে তাদের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। অতিরিক্ত গরমে শিশু বারবার ঘেমে গেলে অবশ্যই পাতলা কাপড় বা গামছা ভিজিয়ে তা দিয়ে বারবার ঘাম মুছে দিতে হবে। কারণ ঘাম যদি শরীরেই শুকিয়ে যায়, তাহলে তা থেকে তার জ্বর, সর্দি, কাশি ইত্যাদি হতে পারে।
শিশুকে ঢিলেঢালা পোশাক পরান
গরমকালে শিশুরা কী ধরনের পোশাক পরছে, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুদের ঢিলেঢালা পাতলা সুতি সাদা কাপড় পরাতে হবে ও নবজাতকদের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা যাবে না। শরীরেরর্ যাশ এড়াতে বা ঘামাচির কষ্ট লাঘব করতে এটা সহায়ক। এ সময় প্রচুর মশা ও পোকামাকড় বেড়ে যায়। তাই অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
নীলফামারী সদর, নীলফামারী।