শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
দায়সারাভাবে চলছে অভিযান

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে মা ইলিশ শিকার

বাঁশখালীতে ১৫ ট্রাক বরফ জব্দ নলছিটিতে তিন জেলেকে জেল কুয়াকাটায় বালু তোলা বন্ধের দাবি চারঘাট-বাঘায় লোক দেখানো অভিযান হিজলায় চলছে অবাধে মাছ বিক্রি
স্বদেশ ডেস্ক
  ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা, পরিবহণ, ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এ সময় বঙ্গোপসাগর থেকে নদী মোহনায় ডিম ছাড়তে আসে মা ইলিশ। কিন্তু দেশের বিভিন্ন মোহনায় অবাধে চলছে ইলিশ শিকার। অন্যদিকে মা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল করতে কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। তবে সেটাকে দায়সারা অভিযান বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে একদিকে চলছে অভিযান অন্যদিকে ধরা হচ্ছে মা ইলিশ। যে কারণে মা ইলিশ নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শনিবার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ রক্ষায় সাগর ও নদীতে মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। তা অব্যাহত থাকবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় হামুনের তান্ডবে বাঁশখালী উপজেলায় ৬ দিন ধরে নেই বিদু্যৎ। আর বিদু্যৎ না থাকার কারণে সাগরে যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বরফ উৎপাদন করতে পারছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বরফ কল মালিকরা। এদিকে অবৈধভাবে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন শত শত বরফ। তাই বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা শহর থেকে ক্রয় করে আনল ১৫ ট্রাক বরফ। আর এসব বরফ অবৈধভাবে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার হবে মর্মে খবর পেয়ে মুহূর্তেই অভিযান চালিয়ে সব বরফ নষ্ট করে দিয়েছে বাঁশখালী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। শুক্রবার বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ফাঁড়ির মুখ ও শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ এবং সরকার বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহর থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসা ১ হাজার বরফের বস্নক নষ্ট করা হয়।

দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই ভ্রাম্যমাণ অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। এ সময় মেরিন ফিশারিজ অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম, ইলিশ প্রকল্প ক্ষেত্র সহকারী, মৎস্য দপ্তরের অন্য কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।

চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজশাহীর চারঘাট এলাকার পদ্মা নদীতে মা ইলিশ শিকারের ধুম পড়েছে। শুধু চারঘাট এলাকাই নয়, উজানে গোদাগাড়ী থেকে ভাটিতে বাঘা এলাকাজুড়ে পদ্মায় মা ইলিশ শিকার চলছে। প্রশাসন দায়সারাভাবে নিষেধাজ্ঞার কথা প্রচার করলেও নদীতে নেই কার্যকর অভিযান। ফলে জেলেরা ইলিশ ধরে প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রিও করছে। ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ইলিশ ধরা ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য এলাকায় প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে নজরদারি করলেও রাজশাহীতে পদ্মা পুরোপুরি অরক্ষিত।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, মৎস্য কর্মকর্তারা লোক দেখানো ঢাকঢোল পিটিয়ে ইলিশ শিকার না করতে প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু নেই কার্যকর অভিযান। মাঝে মাঝে মৎস্য অফিসের লোকেরা নদীর কিনারে অভিযান চালানোর কথা বললে বন্ধ হচ্ছে না মা ইলিশ নিধন কার্যক্রম।

এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের মতিহার, শ্যামপুর, ইউসুফপুর, টাঙ্গন, চারঘাট পিরোজপুর, গোপালপুর, রাওথা, মীরগঞ্জ ও আলাইপুরে পদ্মায় চলছে অবাধে মৎস্য শিকার। এসব এলাকার পদ্মায় দিনের বেলায় জেলেদের মাছ ধরা নৌকা কম দেখা গেলেও গভীর রাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলছে মা ইলিশ নিধনের কাজ।

এ ব্যাপারে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় পদ্মায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। মা ইলিশ ও জাল আটক ছাড়াও জেলেদের আর্থিক জরিমানা করা হচ্ছে।

হিজলা প্রতিনিধি জানান, বরিশালের হিজলা উপজেলার বিভিন্ন নদীতে এটি কাগজপত্রে নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। খোদ জেলেরাই জানিয়েছেন, প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ইলিশ ধরার 'পাস' পেয়েছেন তারা। এ কাজের মাধ্যম হিসেবে আছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা। রাত হলেই পাস নিয়ে নদীতে নামছে কয়েক হাজার জেলে নৌকা। নদীপাড়েই চলছে বেচা কেনা। অস্থায়ীভাবে হাট বসেছে বেশ কয়েক জায়গায়। ইলিশের ভাগের টাকা পাওয়ায় প্রশাসন নীরব দর্শক। যদিও জোরালো সাইরেন বাজিয়ে দিনের বেলা প্রায়ই তারা দায়সারা অভিযান চালাচ্ছে। সরেজমিন জেলেদের সঙ্গে কথা বলে ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

হিজলা উপজেলা বেশ কয়েকটি পয়েন্টে অবাধে চলছে ইলিশ নিধন। প্রকাশ্যে হাট বসিয়ে হচ্ছে বেচাকেনা, এর মধ্যে হিজলা-গৌরবদীর জানপুর ৩ নম্বর মাছঘাট (হটস্পট)। এছাড়াও আসলী আবুপুর, চর আবুপুর, মেমানিয়ার সেচিব মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাটিয়ালা, খালিশপুর, বাউসিয়া রাস্তার মাথা, পুরাতন হিজলা, প্রেম বাজার, কাইছমা, টুমচরসহ বিভিন্ন এলাকায়। হরিনাথপুর ফাঁড়ি ইনচার্জ আব্দুর রহিম জানান, আবুপুরে মাছ বিক্রি হয় আমি শুনেছি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছি। এছাড়াও এখানে একটি অস্থায়ী নৌ পুলিশ ফাঁড়ি আছে তারা নদী দেখাশোনা করেন। হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার সিংহ বলেন, অভিযানকারীদের জলযান দেখেই নৌকাগুলো বিভিন্ন খালে ঢুকে পালিয়ে যায়। আমাদের জনবল কম থাকায় রাতে অভিযান করা সম্ভব নয়।

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে সাগর ও নদীতে। কিন্তু সম্প্রতি অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে সাগর ও নদী মোহনায় ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। মা ইলিশের বিচরণ ও অভিপ্রায় নিরাপদকরণ করার দাবি করেছেন স্থানীয় ইলিশের আড়ত মালিকসহ জেলেরা। শুক্রবার দেখা গেছে, একাধিক ড্রেজারে বালু উত্তোলনের কাজ চলছে। কলাপাড়া উপজেলা মাঝি সমিতির সভাপতি নূরু মিয়া জানান, আন্ধারমানিকের সাগর মোহনায় বছরের অধিকাংশ সময় বালু কাটা হয়। এসব ড্রেজারের বিকট শব্দে মা ইলিশ অন্যত্র চলে যায়। মোহনা থেকে ফিরে যায় গভীর সাগরে। প্রজননকালে অন্তত বালু কাটা যেন বন্ধ রাখা হয়।

স্থানীয় এক মৎস্য ব্যবসায়ী রাজ্জাক সিকদার বলেন, সাগর থেকে নদী মোহনায় যাতে মা ইলিশ প্রবেশ করে ডিম ছাড়তে পারে সে জন্য এ অবরোধ দিয়েছে সরকার। কিন্তু সমুদ্রের মোহনায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ড্রেজারে অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কম্পন ও শব্দ দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের মোহনা দিয়ে মা ইলিশ নদীতে প্রবেশ করতে পারছে না। আর যদি মা ইলিশ নদী মোহনায় ঢুকতে না পারে তাহলে এই ২২ দিন অবরোধ কোনো কাজে আসবে না। সরকারের কাছে দাবি দ্রম্নত এই ড্রেজিং বন্ধ করা হোক। এ বিষয় কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটি ইলিশের প্রজননকালের জন্য ভয়াবহ সমস্যা।

নলছিটি (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি জানান, ঝালকাঠির নলছিটিতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মা ইলিশ শিকার করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে তিন জেলেকে এক বছর করে জেল প্রদান করা হয়েছে। শনিবার সকাল ৮টায় মৎস্য দপ্তরের অভিযানে উপজেলার সুগন্ধা নদীসংলগ্ন অনুরাগ এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- উপজেলার তিমিরকাঠি এলাকার মৃত আশ্রাফ আলী খন্দকারের ছেলে সহিদ খন্দকার (৪০), নলছিটি পৌর এলাকার মৃত সোবহান আকনের ছেলে সোহরাব আকন (৩২) ও আজিজ হাওলাদারের ছেলে সুমন হাওলাদার (২৯)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২শ' মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে