সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলের মাছের উচ্ছিষ্ট যাচ্ছে বিদেশে

মাছের আঁশে তৈরি হচ্ছে প্রসাধনী-বৈদু্যতিক পণ্য পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
টাঙ্গাইলের মাছের উচ্ছিষ্ট যাচ্ছে বিদেশে

মাছে-ভাতে বাঙালির খাবারের অনন্য অনুষঙ্গ 'মাছ'। মাছের আষ্টে বা খোঁসা বা আঁশ বা উচ্ছিষ্ট বিক্রিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারের। ফেলে দেওয়া মাছের এ আষ্টে বা আঁশ এখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মৎস্যজীবীদের মাছের আঁশের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে।

জানা যায়, মাছের আঁশ বলতে সাধারণত মাছের উচ্ছিষ্ট অংশকে বুঝায়, যা সচরাচর সবাই ফেলে দেয়। কিন্তু এই মাছের আঁশের নানাবিধ আশ্চর্য ব্যবহার রয়েছে। এক-দুই হাত ঘুরে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর এখন দেশ থেকেই প্রতি বছর হাজার হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে। টাঙ্গাইল জেলার মাছের বড় বাজারগুলোসহ প্রায় সব বাজারেই 'বটিওয়ালা'রা পাইকারদের কাছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে মাছের আঁশ বিক্রি করছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মাছের আঁশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই আঁশ বিক্রি করে বছরে বাড়তি আয় করছেন মৎস্যজীবীরা। শুধু বাজার নয়, অনেকেই বাসাবাড়ি থেকেও মাছের আঁশ বটিওয়ালারা সংগ্রহ করছেন এবং মাছ ব্যবহারকারী গৃহবধূরা বিক্রি করছেন। বিভিন্ন দেশে এ আঁশ নানা দরকারি ও বিলাস পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টাঙ্গাইলে মাছের আঁশের ব্যবসার পরিধি দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে।

জানা যায়, মাছের আঁশের বিশ্বব্যাপী নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। মাছের আঁশে থাকে কোলাজেন- যা খাদ্য, ওষুধ, ফুড সাপিস্নমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোলাজেন নামক পণ্যটি বিক্রি হয়। চীন ও জাপানে এই আঁশ ব্যবহার করে ইরড়-ঢ়রবুড়বষবপঃৎরপ হধহড়মবহবৎধঃড়ৎ তৈরি করা হয়- যেগুলো দিয়ে রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া যায়। তাছাড়া ঘরোয়া বিদু্যৎ উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই ইরড়-ঢ়রবুড়বষবপঃৎরপ হধহড়মবহবৎধঃড়ৎ। এছাড়া মাছের খোঁসা ব্যাটারি তৈরি, বৈদু্যতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্ণিয়া, মাছ ও পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত কার্প জাতীয় একটি মাছের ওজনের ২ ভাগ পরিমাণ আঁশ থাকে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৭ হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন মাছের আঁশ উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। দেশের হাটে-বাজারে যারা মাছ কাটে তাদেরকে বটিওয়ালা বলা হয়ে থাকে। ওই বটিওয়ালা, পাইকার ও ডিলাররা এসব আঁশ সংগ্রহ করে এবং সংগৃহীত আঁশ বা খোঁসার ৯০ ভাগই রপ্তানি হয়, যা বছরে প্রায় ২৫০০ মেট্রিক টন। মূলত জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চায়নাতে এসব খোঁসা প্রতি মেট্রিক টন ৩৫০ থেকে ৪৭০ ডলারে রপ্তানি করা হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে ২০০ কোটি টাকার মাছে খোঁসা বা আঁশ রপ্তানি করে। এই পেশার সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত। ১০-১২টি দেশি-বিদেশি ট্রেডার এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

গবেষকরা মনে করেন, মাছের আঁশ সবার কাছে উচ্ছিষ্ট হলেও এর অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছের আঁশ বা আষ্টে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু দেশে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনো প্রচলিত হয়নি। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাছের আঁশের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও যথাযথ মূল্যে মাছের আঁশ রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

গবেষকরা জানায়, মানুষের পুড়ে যাওয়া ক্ষতের চিকিৎসা, প্রসাধনী তৈরি, কোলাজেন পাউডার, আঠা, পোশাক ও সাজসজ্জার সরঞ্জাম তৈরি, প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাছের আঁশ ও এর থেকে উদ্বৃত উপাদান ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ভারি ধাতুর দূষণ নিরসন করতে ও পানি বিশুদ্ধকরণের উপাদান হিসেবেও মাছের আঁশ ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

সরেজমিনে মৎস্যজীবীরা জানান, মাছের আঁশ সংগ্রহ করার পর সেগুলো পানিতে অথবা গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে ঝরঝরে করা হয়, এরপরই আঁশগুলো বিক্রির উপযোগী হয়। বছরে দুই থেকে তিন বার পাইকারদের কাছে ওই আঁশ বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা এসে মাছের আঁশগুলো কিনে নিয়ে যায়। প্রতি মণ আঁশ ৩৬০০ থেকে ৪০০০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। শুধু আঁশ নয় পাইকাররা মাছের নাড়িভুঁড়িও কিনে নেয়। নাড়িভুঁড়িগুলো মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মাছের জাত অনুযায়ী আঁশ বা আষ্টের দামও ভিন্ন হয়। রুই-কাতলসহ বিভিন্ন বড় মাছের আঁশের দাম একটু বেশি। আর ছোট মাছের আঁশের দাম তুলনামূলকভাবে কম।

টাঙ্গাইল শহরের বড় দু'টি বাজার- পার্ক বাজার ও ছয়আনি বাজার থেকে ১৫-২০ জন বটিওয়ালা মাছ কাটার পাশাপাশি নিয়মিত মাছের আঁশ বিক্রি করছেন। শহরের ছয়আনি মাছের বাজারে নিয়মিত মাছ কাটেন বটিওয়ালা সজীব। মাছের খোঁসা বা আঁশ ছাড়িয়ে চাহিদানুযায়ী টুকরা করে তিনি ভোক্তাদের দিয়ে থাকেন। এতে ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজিতে মজুরি হিসেবে তিনি ২০-৩০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। মাছের আঁশ বিক্রি করে তিনি বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছেন। প্রতিবছর ৬-৮ মণ মাছের আঁশ তিনি পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন।

মাছের বাজারের অপর বটিওয়ালা মো. সোহেল জানান, তিনি প্রায় ১৪ বছর ধরে মাছের আঁশ বা আষ্টে ছাড়ানোর ব্যবসা করেন। আর মাছের আঁশ বিক্রি করছেন প্রায় ৭ বছর যাবত। বছরে দুই-তিনবার পাইকাররা মাছের আঁশ কিনতে আসেন। চট্টগ্রাম, বগুড়া ও ঢাকা থেকে কয়েকজন পাইকার টাঙ্গাইলে মাছের আঁশ কিনতে আসেন। মাসখানেক আগে তিনি চার মণ মাছের আঁশ ৩৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। দাম এখন কিছুটা কম যাচ্ছে। তারপরও বছরে বাড়তি আয় হওয়ায় তিনি বেশ খুশি।

বগুড়ার মাছের আঁশের পাইকার মো. মনির জানান, তিনি ঢাকায় এক লোকের কাছে বছরে ৪০ টন মাছের আঁশ বিক্রি করেন। টাঙ্গাইলে প্রায় দুই বছর ধরে মাছের আঁশের ব্যবসা করেন তিনি। টাঙ্গাইল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে ৩-৪ টন মাছের আঁশ কিনে থাকেন। বাজার যখন ভালো থাকে তখন ১০০ টাকা কেজি দরে আঁশ কেনেন। এখন বাজার দর একটু কম, প্রতি কেজি ৯০ টাকা দরে কিনছেন।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হারুন-অর রশীদ, তিনি মাছের খোঁসা বা আঁশ থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান তৈরীর প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে পিএইচডি করছেন।

তিনি জানান, বাংলাদেশে মাছের খোঁসা বা আঁশ থেকে বিভিন্ন উপাদান তৈরীর সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, 'মাছের আঁশ বা খোঁসা বা আষ্টে যাই বলি না কেন, এর নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। ওই আঁশ দিয়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে জিন্টপ্যান্ট-গ্যাভার্ডিন কাপড়ের ওপর এক ধরনের আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়, যার ফলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। ক্যাপসুলের খোঁসা ও প্রসাধনী সামগ্রী তৈরীতেও মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছের আঁশ নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করে অনেকে সফল হয়েছেন। মাছের আঁশ এখন বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে