ঝড়-বৃষ্টি-কাদা, রাত-দিন যাই হোক, ডাক পেলেই লাশ নিয়ে ছুটে চলতে হয় বন-জঙ্গলে, থানায়, মর্গে বা নিহতের বাড়িতে। সাধারণত অস্বাভাবিক মৃতু্য, হত্যা, দুর্ঘটনা হলেই ডাক পড়ে শাহীদ ফরাজির। সৎভাবে অর্থ উপার্জন করলে সমাজে কোনো পেশাই ছোট নয়। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য চাই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। চাই শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার। আর এ জন্যই মানুষের আজীবনের সংগ্রাম। এই জীবন সংগ্রামের চক্রে নিরন্তর ঘুরপাক খাওয়া শাহীদ ফরাজি বেছে নিয়েছেন লাশ টানার এক বিচিত্র পেশা। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ভ্যান নিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। এরপর লাশ নিয়ে পৌঁছান শেরপুর সদর হাসপাতাল মর্গে। ডোমের কাটাছেঁড়া লাশ নিয়ে আবার পাড়ি জমান নিহতের আত্মীয়স্বজনের কাছে। এভাবেই শত শত লাশ নিয়ে এপার-ওপার করেছেন তিনি।
শাহীদ ফরাজির বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার গড়েরগাঁও এলাকায়। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের পেশাগত জীবনে লাশ টেনেছে প্রায় ২৫০০-৩০০০। এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা বা অপমৃতু্য কিংবা খুন হলেই তার ডাক পড়ে। রাত-দিন তার কাছে সবই সমান।
লাশবাহক শাহীদ ফরাজি জানান, 'দীর্ঘ ১০ বছর লাশ টানার কাজ করা নিয়ে তার হয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি। লাশ যত গলিতই হোক না কেন, তার কাছে তা আমানত। প্রথম প্রথম লাশ টানতে ভয় লাগতো। একটু নির্জন স্থানে কিংবা আঁধার নামলে গা ছমছম করত। এখন আর এমনটি হয় না। লাশের প্রতি শাহীদ ফরাজির খুব মমতা। শিশুদের লাশ টানতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যায়। কোনো কোনো সময় লাশের পাশে বসেই তাকে রাত কাটাতে হয়। ক্ষুধা লাগলে সেখানেই বসে খেতে হয়।
তিনি আরও জানান, ভ্যানটি থাকাবস্থায় লাশ টানা ভ্যান বলে সেই ভ্যানে কোনো মানুষ উঠত না। ফলে লাশ টানার কাজ না থাকলে তাকে বসেই থাকতে হতো। প্রতি মাসে গড়ে ৪-৫টি লাশ টানতে হয় তাকে। লাশ টেনে যে টাকা পান, তা দিয়েই কোনোমতে চলে তার সংসার। ২ ছেলে মানিক (২০) ও স্বপন (১৩) এবং দুই মেয়ে তানিয়া আক্তার (২৪) ও মিম আক্তার (১৪)। স্ত্রী বানেছা বেগম তার সুখ-দুঃখের সাথী। অভাবের কারণে ছেলে মানিককে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাই মানিক শাহীদের সঙ্গে লাশ টানতে সহযোগিতা করেন।
স্ত্রী বানেছা বেগম জানান, 'বিয়ের পর লাশ টানার কারণে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে কয়েকবার পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আবারও তিনি নিয়ে এসেছেন। এরপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে।' শাহীদ ফরাজি দুঃখ করে বলেন, অনেক লাশ টেনে টাকা পাইনি। অনেকে কম দেয়। আবার বেওয়ারিশ লাশ ফ্রি টানতে হয় শাহীদের। তবুও লাশের খবর পেলে সবকিছু ভুলে যান।
নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের মিয়া জানান, লাশ টানার এই পেশায় কেউ আসতে চায় না। পচা, দুর্গন্ধ এমনকি বিকৃত নানা ধরনের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। সরকারিভাবে এর কোনো বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। জীবনের তাগিদে লাশের প্রতি এ রকম মমতা নিয়ে লাশ বহন করে চলেছেন।