সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুর থেকে শাহজাদপুর উপজেলার হাটপাচিল পর্যন্ত ৬৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সাড়ে ৬ কিলোমিটার যমুনা নদীর ডানতীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে ধীরগতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ২০২১ সালের জুনে একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ছোট-বড় ৩৭টি প্যাকেজে এ প্রকল্পের টেন্ডার করে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০২২ সালের মার্চে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে।
ইতোমধ্যে এ প্রকল্পে এ ৪১১ কোটি টাকা প্রাপ্ত বরাদ্দের মধ্যে ২৮১ কোটি টাকা ঠিকাদারদের বিল প্রদান করা হয়েছে। এ প্রকল্পে নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণ, বস্নক নির্মাণ, বস্নক সেটিং, এনায়েতপুর ও বেতিল স্পার বাঁধ মেরামতের কথা রয়েছে।
এ অবস্থায় সরেজমিন গিয়ে প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের দাবি- সঠিক সময়ে ঠিকাদাররা কাজ না করায় এ অঞ্চলে হাজার বিঘা আবাদি জমি, শত শত বসবতবাড়ি ও অন্তত ৩০টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রসা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ বাঁধ নির্মাণে স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও কর্তৃপক্ষ কোনো কর্ণপাত করেনি। ৩০ অক্টোবরও নদীতীরের সৈয়দপুর পূর্বপাড়া কবরস্থানের কাছে স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর পূর্বপাড়ার বিধবা রাবেয়া খাতুন বলেন, 'নদী ভাঙনের কারণে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাওয়া এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে থাকি। স্বামী মারা গেছে। ৪ ছেলে-মেয়ে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে দিন চলে। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে চোখেমুখে অন্ধকার দেখি।'
স্থানীয় জালালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ওসমান গণি জানান, গত ৩-৪ বছরে যমুনা নদীর প্রায় ৪ মাইল এলাকা ভেঙে বিলীন হয়ে নদী গ্রামের দিকে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে হাটপাচিল, ভেকা, সৈয়দপুর, পাকরতলা, বাঐখোলা, রঘুনাথপুর, ঘাটাবাড়ি, জালালপুর ও রূপসী গ্রাম বিলীন হয়েছে। প্রকল্পের কাজে তীরগতির কারণে এমন অবস্থা হয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হান্নান বলেন, গত কয়েক বছরে এনায়েতপুর থেকে পাচিল পর্যন্ত এলাকার অন্তত ৩০টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী তীরের শত শত বিঘা আবাদি জমি ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থানীয় আব্দুস সালাম জানান, নদীতে পানি কমতে শুরু করায় নদী তীরে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে নদী তীরের মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। দীর্ঘদিনের পুরাতন সৈয়দপুর পূর্বপাড়া কবরস্থানটি নদী থেকে মাত্র ১০ হাত দূরে রয়েছে। এখানে আমাদের বাপ-দাদার কবর রয়েছে। আশপাশে আর কোনো কবরস্থান নেই। এই কবরস্থানটি নদীতে বিলীন হলে মৃত মানুষকে কবরস্থ করার জন্য আমাদের আর কোনো জায়গা থাকবে না।
নদী বাঁচাও আন্দোলনের শাহজাদপুর উপজেলার সভাপতি ফারুক রেজা বলেন, গত কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারিয়ে এ অঞ্চলের হাজারো মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। ঠিকাদাররা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছে। প্রতি নিয়ত নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ছে। এ অবস্থায় দ্রম্নত বাঁধ নির্মাণ এবং অনিয়ম ও লুটপাটে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, স্থানীয়দের কাজের ধীরগতির অভিযোগটি সত্য, তবে বরাদ্দ না থাকায় এবং কিছু ঠিকাদারদের গাফলতির জন্য এ ধীরগতি হয়েছে। এ বছর ১৩০ কোটি টাকার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আশা করা যাচ্ছে বরাদ্দ বাড়লে দ্রম্নত কাজ শেষ করা যাবে।