কামাল পাশা বাড়ি গাইবান্ধার পলাশাবাড়ি উপজেলার তুলশীঘাটের সাতার পাড়া গ্রামে। বসবাস করতেন গাইবান্ধা সদরের খোলাহাটি গ্রামে। পেশায় একজন শ্রমিক। অসুস্থতার কারণে মৃতু্য শয্যায়। কোনভাবে জানতে পারেন বগুড়া শ্রম দপ্তরে আবেদন করলে টাকা পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী আবেদন করেন। আবেদনটি গৃহীত হয় এবং কামাল পাশার নামে ৪০ হাজার টাকা একটি চেক হয়ে বগুড়া কার্যালয়ে আসে। কিন্তু আবেদনে যে ফোন নম্বরটি দেওয়া ছিল সেটা ততোদিনে বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিকানা যেটা দেওয়া ছিল সেখানে আর বসবাস করেন না। এতে করে চরম বিড়ম্বনায় পরতে হয় বগুড়া অফিসকে। উপায়ন্তহীন হয়ে কামাল পাশাকে খুজতে শুরু করে এই দপ্তর। একপর্যায়ে সন্ধান মেলে পাশার পরিবারের। কিন্তু ততোদিনে পাশা বেঁচে নেই।
জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়, তখন অফিসিয়াল প্রসিডিউ অনুযায়ী তার স্ত্রী কাবাশীর নামে চেকটি রি-ইসু্য করার জন্য শ্রম কর্মসংস্থান দপ্তর ঢাকায় পাঠায়। দীর্ঘদিন পর জটিলতা পেরিয়ে চেকটি কাবাশী বেগমের নামে তৈরি হলে তার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০১৭ সালের দিকে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র শিক্ষা সেবার জন্য আবেদন করেন। সে অনুযায়ী তার নামে ৫০ হাজার টাকার একটি চেক হয়। কিন্তু ততোদিনে তিনি সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বগুড়া শ্রম দপ্তরে চেকটি আসলে দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মরত ব্যক্তি মুঠোফোনে চেকটি নিয়ে যেতে বলেন সহাকারী জজকে। কিন্তু সহকারী জজ বুঝতে পারেন না যে, এতোগুলো টাকা কোথা থেকে আসলো। বিষয়টি খোলাশা করে জানতে চাইলে তাকে বিস্তারিত জানানো হয়। তখন মনে পরে শিক্ষা ভাতার জন্য আবেদনের বিষয়টি। ওই সময় বগুড়া নারী ও শিশু আদালতের সহকারী জজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ কারনে চেকটি গ্রহণের অনিচ্ছা থাকলেও সেবামূলক কাজে ব্যয়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে চেকটি গ্রহণ করেন।
এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে বগুড়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অধীনে সারাদেশে শ্রমিকদের কল্যানে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। তবে প্রচারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ সব সুবিধার কথা জানেন না অসহায় মানুষগুলো। কখনো কখনো বিশেষ কোনও মাধ্যমে জানার পর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে আঞ্চলিক দপ্তরে জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। কখনো মুঠোফোনে, কখনো কার্যালয়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পর কর্তা বাবুদের সঙ্গে দেখা করে খোঁজ নিয়ে জানতে হয় কোন অবস্থায় রয়েছে আবেদনটি। এভাবে ঘুড়তে ঘুড়তে অতি কষ্টের উপার্জিত টাকার অনেকটায় ব্যয় হয়ে যায় যাতায়াতে। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন তারা।
তবে পরবর্তী কয়েক বছর পর যখন চেক ইসু্য হয়ে আঞ্চলিক দপ্তরের আসে তখন একদিকে বিড়ম্বনায় পরতে হয় অফিসকে অন্যদিকে সৃষ্টি হয় চেকটি হস্তান্তরের নানা জটিলতা। কারণ কখনো কখনো যার নামে আবেদনটি ছিল ওই ব্যক্তি ততোদিনে আর বেচেঁ নেই। অথবা সাবলম্বী হয়ে গেছেন। চাকরি পেয়ে স্বচ্ছলতা এসেছে কিংবা ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজানা এরকম অনেক ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে এই দপ্তরের উপযুক্ত সিদ্ধান্তহীনতা ও অবহেলা। সরকারের পক্ষ থেকে অসহায় মানুষদের সহযোগিতার উন্নত ব্যবস্থা থাকলেও, বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছে সুবিধাভোগিরা। বরং আবেদনের পর থেকেই নানা ধরনের বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাদের। বগুড়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর থেকে সময় মতো তথ্য প্রেরণ হলেও ঢাকায় পৌছার পর তা ফ্রিজ হয়ে যায় এমন তথ্য উঠে এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে।
দেশে শ্রমিকের সংখ্যানুযায়ী এই দপ্তরের রয়েছে জনবল ও কার্যালয় সংকট। প্রতি উপজেলা একটি করে অফিস দিয়েও সেবা প্রদান করতে হিমসিম খেতে হবে বলে ধারণা শ্রমিকদের। কিন্তু উপজেলাতো দুরের কথা জেলাতেও নেই এই দপ্তরের কার্যালয়। যেমন বগুড়া আঞ্চলিক দপ্তরের অধিনে রয়েছে ৪টি জেলা গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ। যেখানে শ্রমিকের সংক্ষ্যা প্রায় অর্ধকোটি। জানা গেছে অর্ধকোটি শ্রমিকের সেবা দিতে এই কার্যালয়ে জনবল রয়েছে মাত্র ১১ জন।
এ বিষয়ে বগুড়া আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের উপপরিচালক ও রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন্স মোহাম্মদ শহিদুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা সেবার জন্য আবেদনকারীদের মাঝে দ্রম্নত চেক হস্তান্তরের জন্য ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়ন হবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ে একটি পদক্ষেপ নেওয়া অতিব জরুরী। তাই বগুড়া আঞ্চলিক শ্রম অফিস থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিতভাবে জানালে তা ফরোয়ার্ট করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হবে। এবং বিষয়টি বাস্তবায়িত করতে আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা করা হবে।