অনিয়ম, দাম্ভিকতা, প্রশাসনিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, চুরি করা, ধোকা দেওয়া, অনিয়মকে সহযোগিতা করা, এড়িয়ে যাওয়া, দেখেও না দেখান ভান ধরে থাকা ও অনিয়মের জাল পেতে রাখার মাধ্যমেই বগুড়ায় ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ ভবন। অন্যদিকে অবৈধর সার্টিফিকেট দিয়ে নিরবে বসে আছে প্রশাসন-কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ অবৈধ্যভাবে শত-শত বিল্ডিং নির্মাণ হওয়ায়, সাধারণ মানুষগুলো চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটালেও কোনো ভুরুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা গ্রহনের নানা ধরনের নীতিবাক্য শোনালেও এসবের কিছুই হয়নি। বরং এমন নীতিবাক্য শুনিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এ সব ভবন তৈরিতে পৌরসভার অনুমোদন ৫-৬ তলা থাকলেও রাজনৈতিক ও অর্থের প্রভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ১৪ তলা পর্যন্ত। কিভাবে তৈরি হলো এমন অবৈধ স্থাপনা, এমন অনুসন্ধানে নামে যায়যায়দিনের এই প্রতিবেদক। ঘটনায় যেসব তথ্য উঠে আসে তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো ঘুষ বাণিজ্য। অর্থ হলেই সবই মেলে, কোনটা ক্ষতি আর কোনটা লোকসান এসব ভাববার সময় নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।
এই অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি পৌরসভাকে দায়ি করা হলেও, পৌরসভার দেওয়া তথ্যানুযায়ী নেপথ্যে রয়েছে অন্যরাও। যেমন বিদু্যৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, সাব রেজিস্টার কার্যালয়, জেলা প্রশাসনসহ আরও কিছু দপ্তর।
প্রথমে অনিয়মের সূচনা হয় নির্মাণকৃত বাড়ির মালিকের মাধ্যমে। কারন পৌরসভা থেকে ৫ তলার অনুমোদ নিলেও ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন ৭ থেকে ১০ কিংবা তারও বেশি। যত তলা গড়তে পারবে ভাড়ার পরিমান ততই বাড়বে। এসবে সহযোগিতা করেন সংশ্লিট কাউন্সিলর। কারন নির্মানাধীন বাড়িটি ওই এলাকার কাউন্সিলরের সামনেই গড়ে ওঠে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওইসব কাউন্সিলর প্রথমে বাঁধা দিলেও ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের পর পরবর্তীতে সহযোগিতা করতে থাকে। এমনকি পৌরসভা থেকে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেও তা ম্যানেজ কিংবা বাঁধা দেন সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা।
ফায়ার সার্ভিস; ৫ তলার ওপরে অর্থাৎ হাই রাইজ ভবন নির্মাণের আগে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতির প্রয়োজন। তবে অনুমোদন ৬ তলার থাকলেও পরবর্তীতে তা ৭ থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু এসবে আর ফায়ার সার্ভিসের কোন নজর থাকেনা। কারন এখানেও চলে ম্যানেজ প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে বগুড়া ফায়ার সার্ভিসের সহকারি পরিচারক মঞ্জিল হক বলেন, 'এ বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। প্রাইমারি পর্যায়ে ভবনগুলো সনাক্ত করে তাদের চিঠির মাধ্যমে সাবধান করা হচ্ছে। এর পরেও তারা সংশোধন না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিদু্যৎ বিভাগ; সবথেকে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বিদু্যৎ বিভাগ। কারণ অনুমোদহীন ভবগুলোতে যখন বিদু্যৎ সংযোগ দেওয়া হবে না তখন এসব ভবন নির্মাণ একেবারেই বৃথা। কেনো দেওয়া হয় এ সংযোগ এ বিষয়ে বগুড়া নেসকো বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ- ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নাফ বলেন, 'যখন কোন ভবন তৈরি হয়ে যায় সেখানে বিদু্যৎ সরবরাহ করা আমাদের দায়িত্ব। তবে অবৈধ ভবন চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন অথবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে কিংবা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে হয়তো সংযোগ দেওয়া বন্ধ করা যেতে পারে।'
সাব রেজিস্টার; সাব রেজিস্টার অফিসের ভূমিকাও রয়েছে বেশ। কারন বর্তমানে মস্ত বড় ভবন নির্মাণের পেছনে রয়েছে ফ্লাট বাণিজ্য। একেকটি ভবনে অর্ধশতাধিকের উপর পর্যন্ত ফ্লাট তৈরি করে বিক্রি করা হয়। কিন্তু অবৈধ ভবনের ফ্লাট ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল কিভাবে হয়। এ বিষয়ে বগুড়া সদর সাব রেজিস্টার অনিমেষ কুমার সাহা বলেন, 'এ পর্যন্ত আমাদের কাছে এই বিষয়ে কোন চিঠি আসেনি। এবং আমার জানাও নেই।'
জেলা প্রশাসন; একটি জেলার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসন। কারন সবগুলো দপ্তরের চালিকা শক্তি এ কার্যালয়। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিলেই অবৈধ্য ভবন নির্মাণ রোধ ও নির্মিত ভবন উচ্ছেদ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিভিন্ন দপ্তর ও মহল। কিন্তু কি কারনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, তা অজানাই রয়ে গেছে।
তবে বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বহুতল ভবনের অনুমোদন সাধারণত পৌরসভাই দিয়ে থাকে। এর সকল দায়ভার তাদের, কারন ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ যখন শুরু হয়, তখন থেকেই যদি তদারকিতে রাখা হয় তাহলে এ সমস্যা হবার কথা নয়। এছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কোনভাবেই দায় এরাতে পারেন না। তাদের একটু সদিচ্ছা থাকলেই এসব রোধ করা সম্ভব।'
পৌরসভা; অনুমোদন দেওয়া, তদারকি করা, ব্যবস্থা নেওয়া, উচ্ছেদ করা, জরিমানাসহ সব ক্ষমতা রয়েছে পৌরসভার কাছেই। কিন্তু কখনোই এসবে শক্তিশালি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কারন জানতে চাইলে বগুড়া পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বগুড়ার উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, 'বিগত সময়ে শহরের প্রায় শতাধিক ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিষয়টি বেশ আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'