বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

সিলেটের ক্বীনব্রিজে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মোবাইল ফোন ছিনতাই

কাইয়ুম উলস্নাস, সিলেট
  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সিলেটের ক্বীনব্রিজে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মোবাইল ফোন ছিনতাই
সিলেটের কোতোয়ালি মডেল থানার সিসি ক্যামেরা থেকে সংগৃহিত -যাযাদি

মোবাইল ফোনে কথা বলে ক্বীনব্রিজ হেঁটে পার হচ্ছেন সাবধান! সামনে ডানে-বামে, পাশে অথবা পিছনেই ওৎ পেতে আপনাকে টার্গেট করে হাঁটছে ছিনতাইকারী তিন-চারজনের গ্যাং। টার্গেট ব্যক্তির দামী মোবাইল ফোন। ব্রিজের ডাউন নামার সময় ঝাপটা মেরে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে ছিনতাইকারী।

সিলেট নগরীর ঐতিহাসিক ক্বীনব্রিজের ওপর এসব ঘটনা এখন নিত্যদিনের খবর। গেলো একমাসে ভয়ংকর এই ছিনতাইকারী গ্যাংয়ের কবলে পড়েছেন সিলেটের প্রবাসী, দূর উপজেলার আগত ব্যক্তি ও ভোরের অনেক ট্রেন যাত্রী। যায়যায়দিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কয়েকটি ঘটনা ও ছিনতাইকারী গ্যাং সদস্যদের পুরো তৎপরতার চিত্র।

ছবির ঘটনাটি ঘটেছে ২ ফেব্রম্নয়ারী দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে। জকিগঞ্জের কাতার প্রবাসী খুরশিদ আলমকে টার্গেট করা হয়। তিনজন ছিনতাইকারী সুরমা মার্কেট থেকে তাকে অনুসরণ করে। ছিনতাইকারী সদস্যদের একজন আশপাশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখে, আরেকজন ঘি কালারের হুডি পরা ভিকটিম খুরশিদ আলমকে ছিনতাই করা যাবে কিনা, তা পেছনে থাকা অপর ছিনতাইকারীকে সংকেত দিয়ে চলে যায়। খুরশিদ আলম ক্বীনব্রিজের মাঝখান থেকে ডাউনে নামতে শুরু করলে পেছন থেকে আসা ছিনতাইকারী তার ৪৮ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। কোতোয়ালি মডেল থানার সিসি ক্যামেরায় এই দৃশ্য ধরা পড়েছে।

ভিকটিম খুরশিদ আলম যায়যায়দিনকে বলেন, 'ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে আলাপ করতে নগরীর সুরমা টাওয়ারে এসেছিলাম। কাজ শেষে হেঁটে মোবাইলফোনে কথা বলে ক্বীনব্রিজ পার হচ্ছি। ক্বীনব্রিজের ওপরে ওঠার পর হঠাৎ একজন ঝাপটা মেরে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে দৌড়ে যায়। বিষয়টি এসএমপি পুলিশকে অবগত করেছি।'

অনুসন্ধানে একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, কারাগারে থাকা কিছু ছিনতাইকারী জেল থেকে বের হয়েছে। উঠতি বয়সী কিছু ছিনতাইকারীকে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্বীনব্রিজের দক্ষিণ মোড়ে ও সুরমা মার্কেটে মোবাইল ফোন ছিনতাইকারী গ্যাং লিডাররা অবস্থান করে। সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া অনেক ছিনতাইকারী ট্রেন যাত্রী মেধাবী শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনার সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাদের নেতৃত্বে ক্বীনব্রিজের উপরে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন ভোরে সিলেট রেল স্টেশনের প্রবেশপথ, ক্বীনব্রিজের ওপর ও সুরমা মার্কেটের সামনে, জেলা পরিষদ ও জজ কোর্টের ২ নম্বর বারের প্রবেশ ফটকের ফুটপাতে এই ছিনতাইকারী চক্রের অবস্থান। প্রতারণার একাধিক কৌশলে তারা মোবাইল ফোন, মানি ব্যাগ ও টাকা ছিনতাই করছে। তাদের সঙ্গে চাকু থাকে। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছুরিকাহত করে তারা। উঠতি ছিনতাইকারীদের অধিকাংশই ইয়াবা ও গাঁজা আসক্ত বলে সূত্র জানিয়েছে। করিম উলস্নাহ মোড়, হাসান মার্কেটের সামনে ও ক্বীনব্রিজের দুই মোড়ে তারা ঘুরে বেড়ায়।

কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান জানান, বন্দর বাজার ফাঁড়ি ও থানা পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ক্বীনব্রিজের আশপাশের মাদক বিক্রেতাদের আটক করেছে পুলিশ। আশা করি, ক্বীনব্রিজের ওই চক্রকেও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবো ইনশাআলস্নাহ।

পুলিশের নথি অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের ৮ জুলাই ভোর ৫টার দিকে ক্বীনব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে গোয়াইঘাট উপজেলার গুরকুচি (দ্বারীখাই) এলাকার আজিজুর রহমানের ছেলে আব্দুল আহাদ (২০) এরকম ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। ওই সময় তার চিৎকারে আশপাশের মানুষ তিন ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছিলেন।

পুলিশ জানায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কাতার প্রবাসী খুরশিদ আলমের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। ডিসি দক্ষিণ ও এসি থানা ও ফাঁড়ি পুলিশের বিপুল সংখ্যক ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় ক্বীনব্রিজের উপরে থাকা ফুটপাত দখলকারী হকারদের তুলে দেওয়া হয়। ব্রিজের উপরে থাকা হকারদের দোকানের চিপায় এসব ছিনতাইকারী লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দক্ষিণ সুরমা টার্মিনাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই লোকমান হোসেন বলেন, রেলস্টেশনের প্রবেশপথের চারজন ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ক্বীনব্রিজের ওই চক্রের সদস্য আটকে চেষ্টা চলছে।

বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ এসআই মো. ইবাদুলস্নাহ জানান, ভোরে ট্রেনের যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য তার টিম সুরমা মার্কেটের সামনে অবস্থান করছে। মাদক, ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারে টহল টিম নিয়মিত টহলে আছে।

দক্ষিণ সুরমা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল বলেন, 'আমি ওই থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলাম, সেই সময় ক্বীনব্রিজের উপরে ছুরিকাহতের ঘটনার জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছি। ট্রেন যাত্রী শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে নসিবা খাতুন স্কুলের সামনে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেছিল, পুলিশ জড়িতদের আটক করেছে। সুতরাং আমি বলব, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আটক করা না হলে এই অপরাধ থামানো যাবে না। আমার সময়ে আমি, প্রতিটি ব্রিজের মোড়ে টহল পার্টি রাখতাম, তাই এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।'

দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, ক্বীনব্রিজের ওই চক্রের সদস্যদের আটক করতে অভিযান চলমান আছে। ট্রেন যাত্রী, বাস যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি টহল টিম নিয়মিত টহলে আছে।

উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) শাহরিয়ার আলম জানান, সিলেট নগরীকে নিরাপদ রাখতে পুলিশের প্রযুক্তি টিম কাজ করছে। ইতিপূর্বে বন্দর বাজার ফাঁড়ি পুলিশ ইয়াবা বিক্রেতাদের আটক করেছে। ক্বীনব্রিজের ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য গ্রেপ্তারেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।

উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) সজিব খান যায়যায়দিনকে বলেন, ক্বীনব্রিজের ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারে পুলিশের তদন্তের অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে। শিগগিরই ওই চক্রকে আটক করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে