মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ শহরের বড়পুল

এইচ এম মোকাদ্দেস, সিরাজগঞ্জ
  ২৭ জুন ২০১৮, ০০:০০
সিরাজগঞ্জের বড়পুল Ñফাইল ছবি

কালের সাক্ষী হয়ে আজো দঁাড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জের বড়পুল নামে খ্যাত ইলিয়ট ব্রিজ। শহরের ভ‚মি থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচু। প্রায় ১২৫ বছর আগে নিমার্ণকালে এই বড়পুলের নাম ছিল ইলিয়ট ব্রিজ। এই ব্রিজ সিরাজগঞ্জের সবর্স্তরের মানুষের কাছে বড়পুল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বড়পুল হিসাবে পরিচিতি পাবারও রয়েছে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ১৮৯২ সালে যখন এই ব্রিজটি নিমার্ণ করা হয় তখন প্রমত্তা যমুনার শাখা নদী ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের কাটাখালির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া হুড়া সাগর নদী। সিরাজগঞ্জ শহরের প্রথম এবং একমাত্র বড় এই ব্রিজটি নিমাের্ণর পর হুড়া সাগর নদীর দু’পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। এর আগে সিরাজগঞ্জ শহরটি মূলত হুড়া সাগর নদী দ্বারা বিভক্ত ছিল। নৌকা ছাড়া পারাপারের কোনো সুযোগ ছিল না। এ নদী দিয়ে তখন চলাচল করেছে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার এবং বড় বড় পাল তোলা নৌকা। এমনি সময়ের কোনো এক বিকালে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন ইংরেজ মহুকুমা প্রশাসক বিটসন বেল শহরের পশ্চিম পার হতে পূবর্ পারে তার আবাস স্থলে যাচ্ছিলেন। পথে এক দুস্থ মানুষের আতর্নাদ তাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তিনি দেখেন, একজন দুঃস্থ লোক নদী পার হওয়ার জন্য মাঝির নিকট করুণভাবে আবেদন নিবেদন করছে। কিন্তু মাঝি তাকে বিনা পয়সায় নদী পার করতে নারাজ। তিনি জানতে পারেন অভাবী ওই মানুষটি তার পুরো দিনের উপাজর্ন দিয়ে পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী কেনায় তার হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। অপরদিকে, নদী পার হতে না পারলে সে বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না। অনাহারে থাকবে পরিবারের লোকজন। এমন অবস্থায় বিটসন বেল’র অনুরোধে মাঝি দুস্থ লোকটিকে নদী পার করে দেয়। এ ঘটনার পরই বেল নদীর ওপর ব্রিজ নিমাের্ণর উদ্যোগী হন। গঠন করেন ব্রিজ নিমার্ণ কমিটি। তার আহŸানে সাড়া দিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চঁাদা তুলে তহবিল গঠন শুরু করেন। একপযাের্য় তৎকালীন পাবনা জেলা বোডর্, ব্রিজ নিমাের্ণর সহযোগিতাস্বরূপ ১৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিলেন। তবে এই ব্রিজ নিমাের্ণ মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছিল তার সঠিক কোনো হিসাব আজও জানা যায়নি। প্রবীণদের ধারণা এই ব্রিজ নিমাের্ণ তৎকালীন প্রায় অধর্ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। এই ব্রিজ নিমার্ণ করে পাটাতন দেয়া হয়েছিল শাল কাঠের তক্তা দিয়ে। পরে তা কংক্রিট সিমেন্ট বা সিসি ঢালাই করা হয়। ১৮৯২ সালের ৬ আগস্ট তৎকালীন বাংলা ও আসামের গভনর্র স্যার চালর্স ইলিয়ট ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে তার নামানুসারে ইতিহাস সমৃদ্ধ এই ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ইলিয়ট ব্রিজ (বড়পুল)। সেই সময়ের ১৮০ ফুট দীঘর্ ও ১৬ ফুট প্রস্থের এই ব্রিজটি ছিল অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। মূলত এ কারণেই সিরাজগঞ্জের সবর্স্তরের মানুষ এটিকে বড়পুল হিসাবে অলিখিতভাবে নামকরণ করেছে। হুড়া সাগর নদী অনেক আগেই তার গৌরব হারিয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে যমুনার সঙ্গে। প্রভাবশালীদের দখলে এখন কাটাখালিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসাবে ঠায় দঁাড়িয়ে আছে সৌন্দযর্মÐিত, ইতিহাস সমৃদ্ধ সেই ইলিয়ট ব্রিজ তথা বড়পুল। পাকিস্তান আমলে বড়পুলের পূবর্ পারে ছিল মুসলিম লীগের দলীয় অফিস। পশ্চিম পারে ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস। বতর্মানে পূবর্ পারে অবস্থিত বিএনপির দলীয় অফিস। এ কারণে রাজনৈতিক কমর্কাÐও চলে বড়পুলের এপার-ওপারকে ঘিরে। কোনো কারণে সংঘষর্ শুরু হলে বড়পুল হয়ে ওঠে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পুলিশের টিয়ারশেল ছোড়ার প্রাণকেন্দ্র। নোম্যান্স ল্যান্ডে পরিণত হয় এই বড়পুল। তবে বড়পুলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিয়মিতভাবে ব্রিজটির সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কারের অভাবে ব্রিজের গোড়ার দিকের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দখল হয়েছে ব্রিজের আশপাশের অনেক জায়গা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করলে হয়তো একদিন এই বড়পুল ধ্বংস হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী এই ব্রিজটি। উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জ শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত পিলার বিহীন ঝুলন্ত পায়ে হঁাটা এত বড় বিশাল আকারের ব্রিজ সারাদেশের মধ্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বড়পুলের চ‚ড়ায় দঁাড়ালে গোটা শহর দেখা যায়।

রাজনৈতিক দলের কমীের্দর মধ্যে সংঘষর্ শুরু হলে এই বড়পুল নোম্যান্স ল্যান্ডে পরিণত হয়। যে দল বড়পুলের চ‚ড়ায় ওঠে তারাই যেন সংঘষের্ বিজয়ী হয়। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কমীের্দর এবং বতর্মানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কমীের্দর মধ্যে সংঘষর্ চলাকালে বড়পুলের চ‚ড়া দখল করা যেন মূল বিষয় হয়ে ওঠে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে