মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

আকাশমণির নিচে চাপা পড়েছে চাষির স্বপ্ন!

আলফাজ সরকার আকাশ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
  ০৭ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
আকাশমণির নিচে চাপা পড়েছে চাষির স্বপ্ন!
গাজীপুরের শ্রীপুরে আকাশমণি গাছের বাগান -যাযাদি

গাছ পরিবেশ-প্রকৃতি, কৃষি-কৃষকের অন্যতম বন্ধু। কিন্তু একসময় সরকারি সহায়তায় সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় লাগানো গাছই পরে হয়ে উঠেছে কৃষক ও পরিবেশের শত্রম্ন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে চারা উৎপাদন ও রোপণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও এখনো রাস্তার ধারে আবার কোথাও আবাদি জমি কিংবা ধানক্ষেতের আইলে বা পুকুরের চারপাশে সারি সারি বেড়ে উঠছে ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি। আর এরই সঙ্গে দিনের পর দিন ভেঙে যাচ্ছে হাজারো কৃষকের স্বপ্ন।

সারাদেশের মতো গাজীপুরের শ্রীপুরের কৃষক ও স্থানীয়রা কখনো দ্রম্নত লাভের আশায়, কখনো শখের বসে আবার কখনো জোরপূর্বক এ গাছ রোপণ করেছেন। কিন্তু এখন এ গাছের নিচের অংশের মাটি ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণে চাপা পড়েছে টনকে টন শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, ইউক্যালিপটাস দ্রম্নত বর্ধনশীল প্রজাতির গাছ যা মাটির ৫০-৬০ ফুট নিচ থেকেও পানি শোষণ করে তা বাতাসে ছেড়ে দেয়। ফলে পানিশূন্যতা ও অনুর্বরতা দেখা দেয় মাটিতে। গাছটি ১৫-২০ বছর কোনো স্থানে থাকলে সেখানে অপর প্রজাতির কোনো গাছ জন্মাতে অসুবিধার সৃষ্টি করে। কারণ পাতার টক্সিক কেমিক্যাল মাটিতে থাকা নাইট্রোজেন পরমাণু ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এতে মাটির পুষ্টি-প্রবাহও নষ্ট হয়। এই গাছের প্রভাবে এখন তো দেশি ফলের গাছগুলো একে এক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

ইউক্যালিপটাস কেন বপন করেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলার অনেক কৃষক বলেছেন, গাছটি তারা চিনতেন না। সরকারের লোকজনই চিনিয়েছে। আর দ্রম্নত কাঠ হিসেবে বিক্রি করা যায় এবং কাঠের মান ভালো হওয়ায় বিক্রয়মূল্য ভালো। ফলে আয় হয় ভালো।

এ গাছের নিচের ঘরবাড়ির নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের কথা জানিয়ে স্থানীয় আরফান সরকার বলেন, এতদিন পরে এ গাছের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের হতাশ করেছে। তাই নতুন করে এ গাছ রোপণ করা থেকে আমরা বিরত রয়েছি।

গোসিংগা ইউনিয়নের চাষি আমজাদ হোসেন বলেন, আগে বনজঙ্গলের ঘাস খেয়ে আমাদের গরু হৃষ্টপুষ্ট হতো। এখন সেখানে গবাদিপশু চড়ালে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। পশুপাখির স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে মানুষেরও হাঁপানি রোগ দেখা দেয়।

দীর্ঘদিন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করা শ্রীপুর উপজেলা নদী ব্রাজক দলের সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, আম, কাঁঠাল, লিচুসহ অন্যান্য ফলজ কিংবা বনজ গাছের নিচে হলুদ-সবজিসহ একাধিক ফসল উৎপাদন হতো। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বাড়ত পরিবারের আয়ও। এখন আকাশমণি গাছের নিচে হলুদ তো দূরের কথা গবাদিপশু খাওয়ানোর জন্য ঘাসও জন্মে না। তিনি আরও বলেন, এ গাছ লাগানো এলাকায় পাখির বাসা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ গাছের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অধীনে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন টিম গঠন করে যথাযথ গবেষণা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, সবুজ শ্যামল এ উপজেলায় একসময় কাঁঠালের স্বর্গরাজ্য ছিল। আকাশমণি গাছের ব্যাপক রোপণের কারণে আম-কাঁঠালের গাছ মরে যাচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মইনুল আতিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আকাশমণি গাছের রেণুর সঙ্গে বসবাসের ফলে এলার্জি বৃদ্ধি পেতে পারে। যা শ্বাসকষ্ট বাড়াতে পারে।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মূয়ীদুল হাসান জানান, যদিও সামাজিক বনায়নকৃত আকাশমণির নিচে সরাসরি ধানের জমি নেই তবুও এর আশপাশের স্থানে ফসলের কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন অনেক কৃষক। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গবেষণার জন্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ জানান তিনি।

ক্ষতিকর প্রভাব জেনেও আকাশমণির হাইব্রিড জাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের সালনা বীজ বাগান কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, এখানে ইউক্যালিপটাসের সঙ্গে মেহগনির সংমিশ্রণে উন্নত জাতের একটি গাছের চারা তৈরির গবেষণা করা হচ্ছে। তবে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।

এ বিষয়ে শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুল হক যায়যায়দিনকে জানান, ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং এরপর বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। এর পরিবর্তে মিশ্র বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছসহ ২৪ প্রজাতির চারা রোপণের মাধ্যমে বাগান সৃজিত হয়। পর্যায়ক্রমে জনসচেতনতার মাধ্যমে আকাশমণির মতো গাছ থেকে উপকারভোগীদের ফিরিয়ে আনা হবে বলেও জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে