বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

'সরকারি মঞ্জুরি বন্ধ' হুমকি থেকে পিছু হটছে ইউজিসি

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম
আমানুর রহমান
  ১৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ আগস্ট ২০২২, ০৯:২৭

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের লাগাম টেনে ধরতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অভিযুক্তদের সরকারি মঞ্জুরি বন্ধের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটছে। এ পর্যন্ত অর্ধ-ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নানা অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, অজ্ঞাত কারণে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেনি ইউজিসি। অভিযোগ ও তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে ইউজিসি এখন অনেকটাই 'নমনীয়' বলে জানা গেছে। 'সরকারি মঞ্জুরি বন্ধ' হুমকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি'র সদস্য সচিব ডক্টর ফেরদৌস জামান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একজন ব্যক্তি বা কর্মকর্তার অনিয়মের জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি বরাদ্দ স্থগিত বা বন্ধ রাখা যায় না।' তিনি আরও বলেন, 'মঞ্জুরি স্থগিত রাখার প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ ও জটিল। চাইলেই বন্ধ রাখা যায়নি।' অথচ গত ৩১ মার্চ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে ভর্তিসংক্রান্ত বৈঠকসহ অন্য দুটি বৈঠকে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়। এসব বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি মঞ্জুরি যথাযথ ব্যবহার নিয়ে হুঁশিয়ার করা হয়। অন্যথায় সরকারি মঞ্জুরি বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রম্নয়ারিতে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুর রহমান খান অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও আপন ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তদন্ত কমিটির কাছে উপাচার্য নিজের এসব অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন।' তদন্তের পর প্রথমবারের মতো ইউজিসি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল। প্রথম দফায় শো-কজের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায়, দ্বিতীয় দফায় জবাব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্ত এখন ইউজিসি সে নোটিশ এবং অভিযোগ ও তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে 'অনেকটাই নমনীয়' বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি এখন আর 'নাড়া-চড়া' করতেও আগ্রহী নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসি'র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উইংয়ের একাধিক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেছেন, 'নানামুখী চাপে' ইউজিসি আগামীতে 'কারণ দর্শানোর নোটিশ' দেওয়ার বিষয়টি দ্বিতীয়বার ভেবে দেখবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রথম একটি 'কারণ দর্শানোর নোটিশ' দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরো বিষয়টি এখন অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। কর্মকর্তারা পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন,''কারণ দর্শানোর নোটিশ' যেখানে কার্যকর করা গেল না, সেখানে 'সরকারি মঞ্জুরি বন্ধ' করার ক্ষমতা কি ইউজিসির আছে?'' তারা আরও বলেন, 'ইউজিসি'র বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণ মুক্ত পৃথক ও স্বাধীন 'উচ্চ শিক্ষা কমিশন' গঠন ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো কিছু করা যাবে না।' এদিকে, গত দুই বছরে (২০২১-২০২২) দেশের অর্ধ-ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম তদন্ত করেছে ইউজিসি। এগুলো হলো- রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট), ঢাকার বছিলায় অবস্থিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ওই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে সত্যতা এবং গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বা হচ্ছেও না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরিউক্ত তদন্ত প্রতিবেদন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউজিসি'র সদস্য ও চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক দিল আফরোজ যায়যায়দিনকে বলেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম সম্পর্কে তদন্ত করে ইউজিসি তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার ও ক্ষমতা ইউজিসির আইনে নেই। ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে। আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে।' উপরিউক্ত ছয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভিযোগগুলো হচ্ছে, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ নিকটাত্মীয়-স্বজন এবং পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক বেশি নম্বর প্রদান, পরীক্ষার নম্বর টেম্পারিং (কাটাকাটি) করে নিয়োগ, বিজ্ঞাপিত পদের দ্বিগুণের বেশি নিয়োগ, নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রফিকুল ইসলামের ভাই-শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়রা রয়েছেন। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ-পদোন্নতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করে অভিযোগের প্রমাণ পায় ইউজিসি। গত জানুয়ারিতে ইউজিসি সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অস্থায়ী নিয়োগে উপাচার্যের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বজনরা রয়েছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ল্যাবরেটরি স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইউজিসি থেকে কোর্স ও কারিকুলাম অনুমোদনের আগেই ল্যাবরেটরি স্থাপন করে প্রায় ছয় কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাড়া করা ভবনে সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম বা বিভাগ চালু করার মতো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। বিভাগ অনুমোদনের আগেই ৫ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক 'বিগ ডেটা ল্যাব' স্থাপন প্রশ্ন সাপেক্ষ। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউলস্নাহর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়ম, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অব্যাহত অনুপস্থিতির সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল তদন্তে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা কমিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রশাসন যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। উপাচার্য তার শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে বিদায় নেন। ইউজিসি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। এ ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে