বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত

আইনজীবীদের বর্জনে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ

সমিতির সভাপতিসহ তিন আইনজীবীকে হাইকোর্টে তলব
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আইনজীবীদের বর্জনে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে আদালতে ফিরলেও আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার আইনজীবীরা নতুন করে তিন কর্মদিবস আদালত বর্জনের কর্মসূচি দিয়েছেন। তাদের কর্মসূচি চলবে আগামী সোমবার পর্যন্ত। এতে করে আদালতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রার্থীরা আইনজীবীদের বর্জনের কারণে বাড়ি ফিরে গেছেন।

এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে গালিগালাজ ও তার সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট তানভীর ভূঞা, সম্পাদক (প্রশাসন) অ্যাডভোকেট মো. আক্কাস আলী ও অ্যাডভোকেট জুবায়ের ইসলামকে তলব করেছেন হাইকোর্ট।

আগামী ১৭ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির হয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার সকালে আদালত চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে আদালতে ফিরলেও আইনজীবীরা বর্জন অব্যাহত রাখায় কোনো কাজকর্ম হয়নি। এতে আদালতে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। আদালতে কোনো মামলার শুনানি হয়নি, নতুন করে কোনো মামলা দায়ের হয়নি, কোনো আসামির জামিনও হয়নি।

আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী, আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ গ্রামের রিয়াজ চৌধুরী বলেন, 'একটি মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিলাম। আইনজীবীদের বর্জনের কারণে হাজিরা দিতে পারিনি।' তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'জানি না হাজিরা দিতে না পারায় আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় কি না।'

কসবা উপজেলার আকবপুর গ্রামের বিচারপ্রার্থী ফারুক মিয়া জানান, তিনি একটি হত্যা মামলার বাদী। মামলার আসামিরা জামিনে গিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন। বৃহস্পতিবার তার মামলার হাজিরার তারিখ ছিল। তিনি আদালতে আসামিদের জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি আইনজীবীদের বর্জনের কারণে তার মামলার শুনানি হয়নি।

আশুগঞ্জ উপজেলার তালশহর ইউনিয়নের একজন বিচারপ্রার্থী জানান, তিনি ধর্ষণের একটি মামলা করতে আদালতে এসেছিলেন। আইনজীবীদের বর্জনের কারণে তিনি মামলা করতে পারেনি।

আইনজীবী সমিতির চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, তারা তাদের ভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন। তিন দফা দাবিতে তারা নতুন করে তিন কর্মদিবস আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

তাদের তিন দফা দাবি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগারের অপসারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অপসারণ এবং জেলা জজ কোর্টের প্রধান নাজির মমিনুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক বিচার। তাদের এই দাবি আগামী ৯ জানুয়ারির মধ্যে মানা না হলে আইনজীবীরা আরও কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন। তবে জজ কোর্টের প্রধান নাজির মমিনুল ইসলামকে বুধবার বিকালে জজ কোর্টের প্রধান নাজিরের পদ থেকে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের সেরেস্তাদার করা হয়েছে।

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের শেষ কার্যদিবস ছিল। ওই দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে একজন আইনজীবী বিলম্বে একটি মামলা দাখিল করেন। কিন্তু বিলম্ব হওয়ার কারণে ওই আদালতের বিচারক মামলাটি গ্রহণ করেননি। তখন উপস্থিত আইনজীবীরা বিচারককে বলেন মামলার বাদী আইনজীবীদের মতো আইন জানেন না। তাই দেরিতে আদালতে এসেছেন। এখন (১ ডিসেম্বর) মামলাটি না নিলে এক মাস পর মামলার আবেদন করতে হবে। এতে বাদীপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পরে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকও মামলাটি নেওয়ার জন্য বিচারককে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি শুনেননি। সর্বশেষ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ওই বিচারকের এজলাসে গিয়ে মামলাটি নেওয়ার অনুরোধ করেন। তখন বিচারক তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে তারা অভিযোগ করেন।

এ ঘটনায় ২৬ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতি সভা করে ১ জানুয়ারি থেকে সংশ্লিষ্ট আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে আইনজীবীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর আদালত বর্জন শুরু করেন। গত বুধবার দুপুর ২টার পর আইনজীবীরা পুরো আদালত বর্জন করেন।

এদিকে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের পর জারিকারক, সেরেস্তাদারসহ আদালতের কর্মচারীদের বিভিন্ন সময় আইনজীবীদের মারধর ও হেনস্তার অভিযোগে গত বুধবার আদালতের কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করেন। তারা আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন।

এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নান বলেন, 'আইনজীবীরা বিভিন্ন সময় আমাদের জারিকারক, সেরেস্তাদারসহ কর্মচারীদের মারধর ও হেনস্তা করেন। এর প্রতিবাদে বুধবার আমরা কর্মবিরতি পালন করেছি।' তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের ও আদালতের নিরাপত্তার জন্য প্রধান ফটক ও আদালতের বিভিন্ন কক্ষে তালা দিয়েছিলাম।' আদালতে অনেক নথি আছে এসবের নিরাপত্তার জন্যই কক্ষে তালা দেওয়া হয়েছিল।'

এ ব্যাপারে জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, 'আমরা বুধবার আমাদের কর্মসূচি পালন করেছি। বৃহস্পতিবার আমাদের কর্মচারীরা যার যার আদালতে ফিরে গেছেন। বিচারকরাও এজলাসে গেছেন। তবে আইনজীবীরা আদালত বর্জন করায় কোনো কাজকর্ম হয়নি। এতে বিচারপ্রার্থীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।'

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট তানভীর ভূইয়া বলেন, 'একটি মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে আমাদের সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের বিতন্ডা হয়। ওই বিচারক আইনজীবী ও আইনজীবী সমিতি নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। আমরা প্রথমে বিষয়টি জেলা ও দায়রা জজকে অবহিত করেছি তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। পরে আমরা বিষয়টি হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকেও অবহিত করি। পরে ২৬ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতির সভা করে ১ জানুয়ারি থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি।' তিনি বলেন, 'জেলা জজ আদালতের নাজির মমিনুল ইসলাম একজন দুর্নীতিবাজ। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও আমরা একাধিকবার জেলা ও দায়রা জজকে বলেছি।'

তিনি বলেন, 'আমরা কর্মসূচি শুরু করার পর গত বুধবার আদালতের প্রধান ফটকে তালা, আদালতের বিভিন্ন কক্ষে তালা দিয়ে বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি করে।' তিনি বলেন, 'আদালতে ভিডিও করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু গত ২ জানুয়ারি আদালতের একজন কর্মচারী আমাদের কর্মসূচি ভিডিও করেন। তখন আমরা তাকে ভিডিও না করতে নিষেধ করেছি। ওই ভিডিওটি তারা ভাইরাল করে দিয়েছেন।'

অ্যাডভোকেট তানভীর ভূইয়া আরও বলেন, 'মহামান্য হাইকোর্ট আমাকেসহ তিনজন আইনজীবীকে তলব করেছেন। আমরা নির্ধারিত তারিখে (১৭ জানুয়ারি) হাইকোর্টে হাজির হয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দিব।'

এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক বলেন, 'প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসম্মুক্ষে এজলাসে বিচারককে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করায় আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও মর্মাহত। বিচারককে এজলাস হতে নামতে বাধ্য করা সংবিধান ও আইনবিরোধী। এটা একাধারে ফৌজদারি অপরাধ, আদালত অবমাননা ও পেশাগত অসদাচরণ।'

ছবি সংযুক্ত: সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে