পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়। এক সময় পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। বাঙালি মধ্যবিত্তের অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে পাটের সম্পর্ক গভীর। মধ্যবিত্তের সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জুগিয়েছে পাট। পাট বিক্রি করে কৃষক ইলিশ মাছ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন কাপড় কিনতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার পাটের টাকায় ব্রিটেনের ডান্ডি শহর সমৃদ্ধ হয় এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার পাটের টাকায় করাচি-লাহোরের উন্নয়ন হয়েছে। দীর্ঘদিন সেই অবস্থা না থাকলেও বিশ্বে আবারও পাটের রমরমা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। পাটজাত পণ্যের চট, বস্তা, চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, সু্যট-প্যান্ট, চাদর, এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে।
পাটের সুতা দিয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবির কাপড়, টুপি, জিন্স ও গরম কাপড় তৈরি হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে পাট। উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়রও তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট পাতার সু্যপ ও পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক এই তন্তুর বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে। জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাঁধ ও নদী ভাঙনরোধে পাটের বস্তা ব্যবহার হচ্ছে। ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রি হচ্ছে দেশে-বিদেশে।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে গবেষণা দল পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) আবিষ্কার করে। এখন পাটের মালিকানা একমাত্র বাংলাদেশের।
কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ব বাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। হাতে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য ও কার্পেট মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪ দেশে। পাটকাঠি এত দিন রান্নার কাজে জ্বালানি ও ঘরে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার হতো। এখন পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পস্ন্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে।
এমন সুখবরের মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে 'জাতীয় পাট দিবস-২০২৩'। দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'পাট শিল্পের অবদান : স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ'। এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্যর্ যালি, শিল্পকলা একাডেমিতে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার বিতরণ, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে কয়েকগুণ। এরমধ্যে প্যাকিং সরঞ্জাম, স্মার্ট পাটের ব্যাগ, পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট, জুয়েলারি, ম্যাটস, জুতা, স্যান্ডেল, বাসকেট আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলার পরিবেশবান্ধব এ পাট নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে গবেষণা চলছে। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায়। ওই সফলতার হাত ধরেই এখন বাংলাদেশের পাট বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির গাড়ি নির্মাণে, পেপার এবং পাম্প, ইনসুলেশন কাজে, জিও টেক্সটাইলে, ইনজেকশন মোল্ডিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পাট এবং পস্নাস্টিক মিশিয়ে পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সোনালি আঁশ পাট।
পাটের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে জাতিসংঘ প্রাকৃতিক পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে এ উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানের টয়োটা কোম্পানির গাড়ির বডিতে পরিবেশবান্ধব পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমেরিকার শীর্ষ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জিএম মোটরস এবং জাপানের মিতসুবিশি কোম্পানিও তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পাট ব্যবহার করছে। টয়োটা গাড়ির বডির ৩৭ শতাংশ অংশে পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব পস্নাস্টিক তৈরির চিন্তা-ভাবনা চলছে। বর্তমানে গাড়ির দরজার কার্পেটের অংশে, পস্নাস্টিকের ড্যাস বোর্ডে ও বুট বোর্ডের কার্পেটে, বনেট ইনসু্যলেশন প্যাড, আন্ডার ফেল্ট সিট, আন্ডার ভ্যাস ট্রে লাইনার, সান ভিশন প্যাড, হ্যান্ড ব্রেক গেটার ও জ্যাক ব্যাগে পাট ব্যবহার হচ্ছে। গাড়িতে পাট ব্যবহারে এই শিল্পে পাটের ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পাট পাতা একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর শাক। বর্তমানে জার্মান প্রযুক্তিতে দীর্ঘ গবেষণার পর এই পাতার মাধ্যমে উপকারী এমন চা-জাতীয় পানীয় তৈরি হচ্ছে, যা অকল্পনীয়। এই পানীয় ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ মারাত্মক সব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পাটের পাতা শাক ও সু্যপ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাটপাতা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ড, চীন ও জাপানে এ সু্যপের বেশ কদর রয়েছে। পাটকাঠি হার্ডবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। দেশে বছরে তিন হাজার টন পাটকাঠি তৈরি হয়। যা জ্বালানি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। কাগজ শিল্পে পাটের ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে কাগজ শিল্পের জন্য একটি গাছ থেকে কাঠ পেতে সময় লাগে আট থেকে দশ বছর। অথচ মাত্র এক মাসের বয়সি পাটগাছ দিয়েই কাগজ তৈরি সম্ভব বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাট দিয়ে কাগজ তৈরি কাঠের চেয়ে ব্যয় যেমন কম তেমনি অনেক সহজও বটে। এ ছাড়া পাট দিয়ে কাগজ তৈরি করলে গাছ রক্ষা পাবে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বৃদ্ধি পাবে।
এখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের পাটের ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়। সব দিক বিবেচনায় পাটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। টানা দুই বছর ধরে কৃষকপর্যায়ে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে পাট। পাটের বাজারে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। পাট খাত ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন প্রায় ১ কোটি কৃষক। লাভ-লোকসান কাটিয়ে পাট খাত যেন আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশের পাটের তৈরি আধুনিক বিলাসসামগ্রী এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপরিবারে। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রানীর হাতে থাকে পাটের তৈরি বাহারি ব্যাগ। আলোচনা সম্মেলনে পাটের ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। গত ১০ বছর ধরেই বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
কার্বন ফ্যাক্টরি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে চারকোল রপ্তানি হয় ৪ হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন। প্রতি টন চারকোলের মূল্য ছিল ৭০০ ডলার। এ হিসাবে চারকোল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার বা প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
বাংলার পাটের রয়েছে বিশাল গৌরবময় ঐতিহ্য। পাটের আদি ভূমি হলো বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উড়িষ্যা ও বিহার অঞ্চল। এ অঞ্চলে প্রায় ৪০ প্রজাতির পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে বিশ্বের সেরা পাট উৎপাদিত হয়। পাটের ইতিহাসও অনেক প্রাচীন। গ্রিক, মিশরীয়, প্যালেস্টাইন এবং আরব সাহিত্যে পাটের উলেস্নখ আছে সবজি ও ঔষধি গাছ হিসেবে। মনুর শাস্ত্রে পাটের উলেস্নখ আছে-পাট্রা হলো অদ্ভুত ধরনের মসৃণ কাপড় যা গাছের ছাল থেকে তৈরি হয়। মহাভারতেও পাটের উলেস্নখ রয়েছে। আইন-ই আকবরীতে ছালার কাপড়ের উলেস্নখ আছে। রমেশ দত্তের 'দি ইকোনমিকস হিস্ট্রি অফ ইনডিয়া আন্ডার আরলি ব্রিটিশ রুল' বইতে উলেস্নখ আছে ১৮০৮ থেকে ১৮১৫ সালে দিনাজপুর জেলার ১৩ হাজার একর জমিতে পাট চাষ করা হতো। এ থেকেই অনুমান করা যায় এক সময় পাটের কি রমরমা অবস্থা ছিল বাংলাদেশে। বিশ্বের মোট পাটের ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে। এককভাবে বাংলাদেশ বিশ্বে উৎপাদিত কাঁচা পাটের ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে। সরকারের নানা উদ্যোগে দীর্ঘদিন পর সোনালি আঁশে আবার সোনালি স্বপ্ন দেখা দিয়েছে।
পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য এবার ১১ ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, চাষি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- পাটবীজ, পাট ও পাটজাত পণ্যের গবেষণায় সেরা গবেষক ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর মাহমুদ আল হোসেন, সেরা পাটবীজ উৎপাদনকারী চাষি ক্যাটাগরিতে কিশোরগঞ্জের আবু হানিফ, সেরা পাট উৎপাদনকারী চাষি পাবনার এনামুল হক, পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা প্রতিষ্ঠান (হেসিয়ান, সেকিং ও সিবিসি) উত্তরা জুট ফাইবার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান (হেসিয়ান, সেকিং ও সিবিসি) জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেড, পাটের সুতা উৎপাদনকারী সেরা পাটকল হিসেবে আকিজ জুট মিলস লিমিটেড, পাটের সুতা রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনতা জুট মিলস লিমিটেড, বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পাটকল হিসেবে সোনালি আঁশ লিমিটেড, বহুমুখী পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্রিয়েশন (প্রা.) লিমিটেড, বহুমুখী পাটজাত পণ্যের সেরা মহিলা উদ্যোক্তা হিসেবে তরঙ্গ ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের সেরা পুরুষ উদ্যোক্তা হিসেবে গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ৯টি অ্যাসোসিয়েশন ও সমিতিকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী সমিতি, বাংলাদেশ পাট চাষি সমিতি, বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ লেমিনেটিং জুট ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি, বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেজিইএ), বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ), বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ), বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ)।