রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
আজ বিশ্ব পানি দিবস

বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত দেশের তিন কোটি মানুষ

এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ত্বরান্বিত করা'
আলতাব হোসেন
  ২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

পানির অপর নাম জীবন। জীবনের অধিকার মানে পানির অধিকার। পানি থাকলেই জীবন থাকবে। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। সুপেয় পানির প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র পানি সংকট। দেশে সুপেয় পানির জন্য চলছে হাহাকার। উপকূলের নারীদের পানির জন্য মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে খাবার পানি এখন দুষ্প্রাপ্য, সুপেয় পানি পাচ্ছেন না দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলে সুপেয় পানি যেন সোনার হরিণ।

পানির এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব পানি দিবস'। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব পানি দিবস ২০২৩ পালিত হবে। দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন - ত্বরান্বিত করা'। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত এক প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি বছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওতে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয় এবং তার পর থেকে এ দিবস পালনের গুরুত্ব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে পানি নিয়ে বিশ্ব যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাংকের কৃষি বিষয়ক পরামর্শক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, পানির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে বিশুদ্ধ

পানি পাচ্ছেন না প্রায় তিন কোটি মানুষ। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যায় সুপেয় পানির অভাবে। আশঙ্কাজনকভাবে ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে ঢাকায় সমুদ্রের লবণ পানি চলে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজধানীবাসীর ব্যবহৃত পানির ৮৬ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানি। মাত্র ১৪ ভাগ পানি উপরিভাগের। দেশে এক কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় সাড়ে ১৬শ' লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এতে সেচের পানি সংকট তীব্র হচ্ছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে প্রতি বছর গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল পাঁচ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে চাষাবাদ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি না হওয়ায় মৌসুমে ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। বাংলাদেশে আমন ও বোরো ধান আবাদের মৌসুমে নদ-নদীতে পানি পাওয়া যায় না। উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়। গবেষকরা বলছেন, দ্রম্নত বরফ গলার কারণে আগামী ৪০ বছরের মধ্যে পুরোপুরি ভেসে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকংসহ প্রধান দশ নদী ও তাদের অববাহিকাগুলো। ফলে পানির জন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এই অঞ্চলের বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, চায়না, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, ভুটানসহ আট দেশের মানুষ। ২০৩০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান, গম ও ভুট্টার ফলন ১০ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সারা দেশে এখন পানি সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের নদ-নদী ও জলাশয়ের পানির প্রভাব নির্ভর করে আন্তঃদেশীয় পানির প্রাপ্তির ওপর। এই সংকটে দেশের অভ্যন্তরের নদী ও জলাশয় দূষণ ও ভরাট হচ্ছে। এতে খাবার পানির উৎস কমছে। নৌ চলাচল, কৃষি-মৎস্য চাষ বিঘ্ন হচ্ছে। পানি সংকট নানাদিক থেকে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রায় ৭ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ ভুগছেন অতিমাত্রায়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণে খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। উপকূলের মানুষকে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম ৭০ থেকে ১০০ টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন চলে যায়।

কৃষিবিদ ডক্টর শহীদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। গ্রীষ্মের শুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সংকটে ব্যাহত হয় জনজীবন। ক্রমেই পানি সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে বরেন্দ্র অঞ্চল। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সারা দেশে সেচের জন্য প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি উঠেছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। জলবায়ুর প্রভাবে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে পানি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষ।

পরিবেশবিদ ইব্রাহিম খলিল বলেন, বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। গ্রীষ্মের শুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সংকটে ব্যাহত হয় জনজীবন। ক্রমেই পানি সংকটপূর্ণ হয়ে উঠছে বরেন্দ্র অঞ্চল। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিয়দংশ এলাকাজুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। এক যুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুট বা তার নিচে না গেলেও পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৫ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। পানির অভাবে ফসলের চাষ বন্ধ হয়ে গেছে বরেন্দ্র এলাকার অনেক উপজেলায়। সুপেয় খাবার পানি নিয়ে সংঘাতে প্রাণহানিও হয়েছে একাধিকবার। পানি না পেয়ে এলাকা ছাড়ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ। ইতোমধ্যে এই অঞ্চল থেকে শতাধিক প্রজাতির প্রাণী ও পোকামাকড়সহ বিভিন্ন জাতের গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ পানি আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন বলেন, উন্নত জীবনযাপনের প্রয়োজনে মানুষের দৈনিক মাথাপিছু পানির চাহিদা বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬টি হচ্ছে সুপেয় পানি নিয়ে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য যা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে পানি ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য দেশে ২৩টি আইন রয়েছে। সুপেয় পানির জন্য পানি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা আছে। পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষকে আগামী ২ বছরের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের পানি ৯০ শতাংশ ব্যবহারের জন্য মানুষকে সচেতন করতে হবে। পুকুর বা জলাশয় ব্যক্তিগত হলেও ভরাট করা যাবে না, এমন আইন থাকার পরও প্রকাশ্যে পানির আধার ভরাট করা হচ্ছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম 'দি এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সংকট ভয়াবহ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯ দেশের মধ্যে ৩৭ দেশেই পানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়। এ অঞ্চলগুলোতে খাবার পানির পাশাপাশি সেচের সংকট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। প্রতি বছর গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল পাঁচ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। এসব দেশে গড়ে বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে এক মিটার পানি রিচার্জ হয়। এ ছাড়া বর্ষার বৃষ্টি ও বন্যায় বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতি বছর বৃষ্টি ও বন্যার পানি রিচার্জ হচ্ছে না। আমন ও বোরো ধান আবাদে অতিরিক্ত সেচ দিতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে পড়েছেন বাংলাদেশ।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, নিরাপদ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের সুযোগ নেই এমন ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশির ভাগই বাস করে উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে। উপকূলীয় এলাকায় এ সংকট সর্বাধিক। সেখানে সুপেয় পানির আধার কম। উপকূলীয় এলাকায় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা, আর্সেনিকের উপস্থিতি ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গত এলাকার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ এখনো সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে