সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলের পশুর হাটে চোখ রাঙাচ্ছে দাম

আড়াইশ' হাটে কোরবানির পশু দুই লাখ
স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল
  ২৭ জুন ২০২৩, ০০:০০

আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার ২৪১টি স্থায়ী ও দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাটের জন্য এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি। তারপরও হাটগুলোতে পশুর দাম আকাশচুম্বী। ৬-৭ মণ ওজনের একটি ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়ের দাম হাঁকা হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। ৪-৫ মণ ওজনের ষাঁড়ে দাম হাঁকা হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে লালন-পালনকৃত দেশি জাতের গরুর দাম আরও বেশি।

বিভিন্ন পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ছোট পশুর চেয়ে বড় পশুর দাম তুলনামূলকভাবে কম। ৪-৫ মণ ওজনের গরুর দাম সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সাধারণ শ্রেণির ক্রেতারা এককভাবে কোরবানির গরু কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে ২ থেকে ৭ জন মিলে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গরু কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। একই রকমভাবে মহিষ, ছাগল ও ভেড়াও হাটগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পশুর হাটগুলোতে একটি মাঝারি সাইজের গরুর জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা এবং ক্রেতার কাছ থেকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা হাসিল রাখা হচ্ছে।

জেলার সবচেয়ে বড় ষাঁড় ৫২ মণ ওজনের 'মানিক'। এটির দাম হাঁকা হচ্ছে ১৬ লাখ টাকা। গত বছর এ ষাঁড়টির ওজন ছিল ৪৫ মণ আর দাম চাওয়া হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। সে সময় ঢাকার গাবতলী হাঁটেও বিক্রির জন্য নেওয়া হলেও ষাঁড়টি বিক্রি হয়নি। ষাঁড়টি নিয়ে হামিদা আক্তার এক প্রকার বিপাকেই পড়েছেন। গত বছর বিক্রি না হওয়ায় তিনি এবার কিছুটা কম দামে হলেও ষাঁড়টি বিক্রি করতে চান।

পশু বিক্রেতা হারুন, রাশেদ, আবুল খায়ের, রাসেল আহাম্মেদ, আজগর আলী, নাজমুল করিম, খোদেজা বেগম, রাইশা ইসলাম, হামিদা আক্তার, আজিজ মিয়াসহ অনেকেই জানান, 'কোরবানির পশুর দাম গত বছরের তুলনায় বাড়েনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার সঙ্গে তুলনা করলে পশুর দাম মোটেই বাড়েনি। গরু লালন-পালন ছাড়াও হাঁটে ওঠাতে গরুর পেছনে বাড়তি খরচ আছে। তাছাড়া বিক্রি করলে হাটের খাজনা পরিশোধ করতে হয়।' তারা বলেন, 'এখন পশু লালন-পালনে ভুসি, নালি (এক প্রকার জোলা গুড়), খৈল, চালের গুড়া, খড়, কাঁচা ঘাস ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। এসবের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তারপরও এবার কোরবানির পশুর দাম বেড়েছে বলা হচ্ছে এটা ঠিক না।'

কোরবানির পশু ক্রেতা জহুরুল ইসলাম, আলতাফ হোসেন, হুসেইন জহুর, খান আলী জাহান, আব্দুল আজিজ মিয়া, কলিম তরফদার, আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ জানান, কোরবানির পশুর দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। গত বছর যে গরু ৮০-৯০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত এবার তার দাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হাঁকা হচ্ছে। তবে বড় গরুর দাম তুলনামূলকভাবে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকা গরু অর্থাৎ ৪ থেকে ৬ মণ ওজনের একটি গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে তারা ২ থেকে ৭ জন মিলে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (ভাগীদার) গরু কোরবানি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।

গোবিন্দাসী গরুর হাটে খাজনা (টোল) আদায়কারীরা জানান, তারা নিয়মানুযায়ী খাজনা আদায় করছেন। কোনোভাবেই অতিরিক্ত খাজনা (টোল) নিচ্ছেন না। কোরবানির গরুতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই খাজনা দিয়ে থাকেন- এটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় সরকারি অর্থাৎ স্থায়ী হাট রয়েছে ২৪১টি। কোরবানি উপলক্ষে জেলায় দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে ভূঞাপুরের স্থায়ী ৯টি হাটের মধ্যে গোবিন্দাসী গরুর হাটটি সবচেয়ে বড়। ৯০ দশকে এটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। নানা কারণে ওই হাট এখন জৌলুস হারিয়েছে। দীর্ঘ চার বছর ধরে সরকারিভাবে খাস কালেকশন করা হচ্ছে। এছাড়া মাটিকাটা, সারপলশিয়া, শিয়ালকোল, সিরাজকান্দি, অজুর্না, নিকরাইল ইত্যাদি হাটগুলো প্রসিদ্ধ।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ২৩টি হাটের মধ্যে বেবিস্ট্যান্ড, অয়নাপুর, যুগনী, রসুলপুর, চারাবাড়ী, করটিয়া ইত্যাদি হাটগুলো পশু বেচাকেনার জন্য অন্যতম। কালিহাতীর ২৫টি স্থায়ী হাটের মধ্যে এলেঙ্গা, মগড়া, আউলিয়াবাদ, মরিচা, বলস্না, রামপুর, পৌজান ইত্যাদি। ঘাটাইলে ১১টি হাটের মধ্যে কদমতলী, হামিদপুর, পাকুটিয়া, ব্রাহ্মণশাসন, ধলাপাড়া ইত্যাদি। মধুপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে কাকরাইদ, শোলাকুড়ি, চাপড়ী, গাংগাইর, বানরগাছি প্রভৃতি। ধনবাড়ীর ১১টি হাটের মধ্যে মুশুদ্দি, পাইস্কা, কদমতলী, কেরামজানী প্রভৃতি। দেলদুয়ারের ১৫টি হাটের মধ্যে দেলদুয়ার, নালস্নাপাড়া, লাউহাটি, রূপসী, ফাজিলহাটী ইত্যাদি। নাগরপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে তেবাড়িয়া চাঁদগঞ্জ, সলিমাবাদ, শাহজানী, গয়হাটা ইত্যাদি। মির্জাপুরের ৩৬টি হাটের মধ্যে দেওহাটা, ফতেপুর, জামুর্কী, মির্জাপুর ইত্যাদি প্রসিদ্ধ পশুরহাট হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া মির্জাপুর উপজেলায় ১১২টি দৈনিক বাজার রয়েছে- সেগুলোর কয়েকটিতে অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সখীপুরের ৩৮টি হাটের মধ্যে দাঁড়িয়াপুরের ছিলিমপুর, কালিদাস, কচুয়া, বড় চওনা, কাইতলা, তক্তারচালা, বহেড়াতৈল, নাকশালা ইত্যাদি। এর মধ্যে কাইতলা পশুর হাটে খাজনা কম নেওয়ায় বর্তমান সময়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। বাসাইলের ১৮টি স্থায়ী হাটের মধ্যে বাসাইল, কাশিল বটতলা, মৈশাখালী, কাউলজানী, হাবলা, আইসড়া ইত্যাদি এবং গোপালপুর উপজেলার স্থায়ী ১৮টি হাটের মধ্যে নলীন, ভেঙ্গুলা, গোপালপুর, মির্জাপুর, আলমনগর ইত্যাদি হাটগুলো পশু বেচাকেনার জন্য প্রসিদ্ধ।

এদিকে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ, বিকিকিনি ও পরিবহণ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কোরবানির চামড়া পশুর শরীর থেকে ছাড়াতে সতর্কতার সঙ্গে বৈধ পদ্ধতি ব্যবহার ও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সবাইকে সচেতনতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭ হাজার ৬২০টি গরু, ৩১৭টি মহিষ, এক লাখ ২০ হাজার ১৫৮টি ছাগল এবং ৩ হাজার ৮৪৬টি ভেড়া রয়েছে। গত বছর এক লাখ ৭০ হাজার ৪২৭টি পশু জেলায় কোরবানি করা হয়েছে। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় এ বছর দেড় লাখের অধিক পশু কোরবানি হবে বলে ধারণা করছে। তারপরও গত বছরের তুলনায় এবার ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন খামারে কোরবানির পশু মোটাতাজা করা হয়েছে। কোনো কোনো খামারি বস, বাংলার বস, মানিক, কালা মানিক ইত্যাদি নামে বড় জাতের (ফ্রিজিয়ান) গরু লালন-পালন করে জেলাসহ দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. রানা মিয়া জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় প্রায় ২৫ হাজার বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার খামারি গরুর হাট ছাড়াও অনলাইনে বিক্রি করছেন। প্রায় খামারিই গরুর অনলাইন ভিত্তিক পেইজ খুলে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়েরও একটি পেইজ রয়েছে। ক্রেতারা সেখান থেকেও পছন্দের পশুটি কিনতে পারছেন।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মহাসড়কসহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে গরু পরিবহণের ট্রাকগুলোকে পুলিশের বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি রোধে জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে। জেলার গরুর হাঁটগুলোতে পুলিশের টহল টিম সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। হাঁটের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা পুলিশ নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে