রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিক নিহতের ঘটনার বিচার দাবিতে সমাবেশ, বিক্ষোভ

নূ্যনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান বলপ্রয়োগের নিন্দা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ গাজীপুরের ৯ কারখানা পুলিশের মামলায় আসামি ৪ হাজার, গ্রেপ্তার ১১
যাযাদি রিপোর্ট
  ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শ্রমিক হত্যার বিচার ও নূ্যনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন পোশাক শ্রমিকরা -যাযাদি

সরকার ঘোষিত চূড়ান্ত নূ্যনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে শুক্রবার রাজধানীতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও জোট। সাড়ে ১২ হাজার টাকার বদলে শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানানোর পাশাপাশি আন্দোলনে তিন শ্রমিক নিহত হওয়ার কথা উলেস্নখ করে বিচার দাবি করেছেন তারা। এদিকে, নূ্যনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনরত পোশাককর্মীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত দুই পোশাকশ্রমিক নিহতের কথা উলেস্নখ করে সংস্থাটি এক বিবৃতিতে শ্রমিকদের ওপর সহিংস দমন-পীড়ন বন্ধ এবং নিহতের ঘটনা অবিলম্বে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে পল্টন মোড়ের দিক থেকে প্রথমে মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে আসে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট। পরে সংগঠনটি প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করে।

সমাবেশে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের নেতারা বলেন, শ্রমিকেরা ঘোষিত নূ্যনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবিলম্বে সর্বনিম্ন মজুরি ২৩ হাজার টাকা ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়। এতে শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি খালেকুজ্জামান লিপন ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বেলা ১১টার দিকে পুরানা পল্টন থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আসে বাংলাদেশ ওএসকে গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন নামে একটি সংগঠন। তারাও ১২ হাজার ৫০০ টাকার নূ্যনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে।

এ সমাবেশে সংগঠনের নেতা তোফাজ্জল হোসেনের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াসিন ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত।

অন্যদিকে শ্রমিক ফেডারেশনের দাবি ছিল শ্রমিকদের মজুরি নূ্যনতম ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ। প্রেস ক্লাবের সামনে শ্রমিক ফেডারেশনের করা সমাবেশে নেতারা বলেন, শ্রমিকরা ন্যায্যভাবে যখন মজুরির জন্য আন্দোলন করছেন, তখন সরকার মালিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। শ্রমের বিনিময়ে মজুরি চেয়ে শ্রমিকরা গুলি পাচ্ছেন। ফেডারেশনের নেতারা আন্দোলনে নিহত তিন শ্রমিকের কথা উলেস্নখ করে বিচার চান। নিহত তিনজন হলেন- শ্রমিক আঞ্জুয়ারা, রাসেল ও ইমরান।

বেলা সোয়া ১১টায় প্রেস ক্লাবসংলগ্ন ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে সমাবেশের জন্য দাঁড়ান ১১টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের নেতারা। আগের দুটি সংগঠন সমাবেশ শেষ করলে তারা প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে সমাবেশ শুরু করেন। আন্দোলনে নিহত তিন শ্রমিকের কথা উলেস্নখ করে তারা বিচার দাবি করেন। এ ছাড়া নির্ধারিত নূ্যনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান, ১৩/১-এর ধারা বন্ধ করে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ এবং অবিলম্বে মজুরি পুনর্বিবেচনা করে ২৫ হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরি করার দাবি জানানো হয়।

সমাবেশে জোটের সমন্বয়ক তাসলিমা আক্তার বলেন, 'সরকার যে মজুরি ঘোষণা করেছে, তা আমাদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে না। আমরা যে মজুরি দাবি করেছি, মজুরির ধারে-কাছেও সেই প্রস্তাবনা নেই। সরকার ও মজুরি বোর্ড বলছে ৫৬ ভাগ মজুরি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট ধরলে ৩৯ ভাগ হয়। এর থেকেও কমে আসে মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে।'

পেঁয়াজ ও আলুর দাম যে জায়গায় পৌঁছেছে, সাড়ে ১২ হাজার টাকায় শ্রমিকদের পক্ষে কোনোভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয় বলে জানান। তাই এই নূ্যনতম মজুরি ঘোষণা তারা প্রত্যাখ্যান করেন। সমাবেশে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ, শ্রমিক নেতা সাদেকুর রহমান, মাসুদ রেজা, শবনম হাফিজ, বিপস্নব ভট্টাচার্য ও তফাজ্জল হোসেন প্রমুখ।

'মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন'-এর সমাবেশের পাশেই গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (জি-স্বপ) মজুরি ২৫ হাজার টাকার দাবিতে সমাবেশ করে।

পরিষদের সমন্বয়ক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, 'গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাদের মজুরি আন্দোলনে মাঠে রয়েছে। এটা কোনো ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা কোনো ধরনের জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-অবরোধের সঙ্গে যুক্ত নই। আমরা শুধু আমাদের জীবন ধারণের মজুরির জন্য লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমি যখন আমরা রুটি-রুজির প্রশ্নে লড়াই করি, সংগ্রাম করি, তখনই আমাদের শ্রমিকদের হত্যা করা হয়, আমাকে আহত করা, আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, আমাকে তুলে নেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'কেউ কেউ বলেন, আমাদের সরকার নাকি শ্রমবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব। আমরা এই সমাবেশ থেকে বলতে চাই, কারও শ্রমবান্ধব হওয়ার দরকার নাই, কারও শ্রমিকবান্ধব হওয়ার দরকার নাই। আমি আমার জীবনধারণের জন্য ২৫ হাজার টাকা চাই, যা দিয়ে আমি আমার পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে পারব। আজকে যে মজুরি ঘোষিত হয়েছে, এটা কোনোভাবে শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই মজুরির ঘোষণা প্রত্যাহার করতে হবে।'

সমাবেশ চলাকালে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের জোটভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ধাপে ধাপে পল্টনের দিক থেকে মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবে এসে সমাবেশে যুক্ত হন। এসব সংগঠনের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, রাষ্ট্র সংস্কার শ্রমিক আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (জি-স্বপ) ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি।

সমাবেশ চলাকালে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও শ্রমিকদের ভিড়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে যান চলাচল সীমিত হয়ে যায়। পরে পুলিশ সদস্যরা সমাবেশকারী ব্যক্তিদের ফুটপাতের দিকে সরিয়ে যান চলাচলের জন্য রাস্তা করে দেন।

৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

এদিকে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার ৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার সকালে কারখানার ফটকে বন্ধের নোটিশ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নোটিশ দেখতে পেয়ে কাজে আসা শ্রমিকরা ফিরে গেছেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার গাজীপুরের তিনটি এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের হামলা ও ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে দিনভর উত্তপ্ত ছিল নগরীর কয়েকটি এলাকা। এ সময় শ্রমিকরা তুসুকা নামে একটি পোশাক তৈরি কারখানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ ছাড়া কারখানার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা পুলিশের তিনটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ১৫ জন শ্রমিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ২২টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে তিনটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

গাজীপুর শিল্পপুলিশ জোন-২ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহমেদ জানান, কোনাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার ২২টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করার খবর তাদের কাছে রয়েছে।

পুলিশের মামলায় আসামি ৪ হাজার, গ্রেপ্তার ১১

অন্যদিকে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে একটি কারখানার বাইরে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুর মহানগর পুলিশের কোনাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ মামলায় ১১ জনের নাম উলেস্নখ করে আরও ৩-৪ হাজার অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

মামলার বাদী এসআই আবু সাঈদ জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে কোনাবাড়ী এলাকায় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে তুসকা গার্মেন্টস কারখানার ভেতর শ্রমিকরা ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এ সময় তারা ওই কারখানার সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে থাকা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনারের (ডিসি) গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনকে আটক করে। আটককৃতরা সবাই বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক।

তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় মামলা করা হয়। ওই মামলায় আটক ১১ জনের নাম উলেস্নখ করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩-৪ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। অন্যান্য আসামির গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে