মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার পাশাপাশি সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে রোববার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক দফা টানা ভারী বৃষ্টি ঝরেছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অলিগলি ও প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষকে পোহাতে হয়েছে চরম ভোগান্তি। টানা বর্ষণে চট্টগ্রামসহ পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ফের বাড়ছে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি। মেঘালয় সীমান্তের কাছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার চাড়াগাঁও এলাকা দিয়ে প্রবল বেগে ঢলের পানি প্রবেশ করছে। তাহিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ক্রমেই পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। এতে আবার সেখানে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় সকালে এক দফা টানা ভারী বর্ষণের পর বেশকিছু সময় রোদ ঝলমল আকাশ থাকলেও দুপুরে দিকে আকস্মিক চারদিক ঘন অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমে আসে। বেলা আড়াইটার পর শুরু হয় আরেক দফা ভারী বৃষ্টি। এতে ঢাকার অলিগলিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততম সড়ক বৃষ্টিতে পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়। দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটুপানি মাড়িয়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে অনেককে। নগরবাসীর অভিযোগ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পানি-নিষ্কাশন-ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ভারী বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টিতে রাজধানীর নয়াপল্টন, শান্তিনগর, মালিবাগ, সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, সদরঘাট, সূত্রাপুর, বংশাল, নাজিমউদ্দিন রোড, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট নতুন রাস্তা, ধানমন্ডি, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর ও বসিলার কিছু অংশ, মেরুল-বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, মিরপুর ১০, ১১, ১২, ১৩ ও হাতিরঝিলের কিছু অংশ, গুলশান লেকপার এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলি ডুবে যায়।
দুপুরে হাতিরঝিল-সংলগ্ন মধুবাগ এলাকার সড়কে এক হাঁটুর বেশি পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে একাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অলিগলি ডুবে যাওয়ায় ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা সব ভেসে ওঠে বিভিন্ন গলিতে। ময়লা পানি পেরিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'সকালের ভারী বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে ক্লাসে গেলাম। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে দেখি গলিতে পানি জমে গেছে। ড্রেনের সব ময়লা ওপরে ভাসছে।' বছরের পর বছর ধরে একই অবস্থা চললেও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই- যোগ করেন এই শিক্ষার্থী।
সূত্রাপুরের বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বছরের পর বছর এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু টনক নড়ছে না কারো।
শান্তিনগর মোড়ে মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষার্থী জাইমা সুলতানা। তারা বলেন, 'এই এলাকায় বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। স্কুলে আসা যাওয়ার কষ্ট হয়। সকালবেলা বৃষ্টি মাথায় করে কোনো রকমে স্কুলে গেলেও দুপুরের ভারী বৃষ্টিতে বাসায় পৌঁছাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখানে কোনো রিকশা পাচ্ছি না। রাস্তায় ময়লা পানির মধ্যে জুতা পায়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে।
মালিবাগ মোড়ে কথা হয় পথচারী আব্দুল হামিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'হাতে জুতা নিয়েও হাঁটতে পারছি না। রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। সবসময় এই এলাকায় যাতায়াত করি। এক ঘণ্টার বেশি বৃষ্টি হলেই আমাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। প্রতি বছর বর্ষা এলেই এই এলাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বাসা মৌচাক হওয়ায় চারপাশে যেদিকে যাই পানি জমে থাকে।'
এদিকে মৌচাক মোড়ে দাঁড়িয়ে রাস্তায় যানবাহনের সংকটের কথা জানান সফি উদ্দীন। তিনি বলেন, 'পল্টন যাব, বাস আসছে না অনেকক্ষণ ধরে। একটা বাস এলেও ধাক্কাধাক্কি করেও উঠতে পারিনি। রিকশা ও সিএনজি ভাড়া বেশি। আবার রাস্তায় পানি জমে থাকার কারণে হেঁটেও যেতে পারছি না।
যায়যায়দিনের চট্টগ্রাম বু্যরো অফিস জানায়, টানা ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। রোববার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। এতে সকাল নয়টা থেকে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। কোথাও কোথাও গোড়ালি থেকে হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায় রাস্তাঘাট ও অলিগলি।
বৃষ্টিতে নগরের চকবাজারের কাঁচাবাজার, মুহাম্মদ শাহ আলী লেন, হাসমত মুন্সেফ লেন, কাপাসগোলা, বাকলিয়ার ডিসি সড়ক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সকালের ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় নগরবাসী দুর্ভোগে পড়েন। বিশেষ করে সকালে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ায় পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মহাবিপাকে পড়তে হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার সকাল নয়টা থেকে রোববার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে রোববার সকাল নয়টা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় চট্টগ্রামে।
এদিকে এই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়ার কথা জানিয়ে চকবাজারের বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, সকালে ভারী বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। টানা বৃষ্টিতে সে আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে। বৃষ্টিতে গলিতে হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায়। তা ডিঙিয়ে কর্মস্থলে যেতে হয়েছে।
নগরের বাকলিয়ার ডিসি সড়কের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, এলাকা যেখানে সড়ক উঁচু করা হয়েছে, সেখানে কম পানি উঠেছে। আর সড়ক যেখানে আগের মতো রয়েছে, সেখানে হাঁটুর ওপরে পানি জমেছে। এতে অফিসে যেতে দুর্ভোগে পড়তে হয়।
এদিকে এ ধরনের টানা বৃষ্টি আগামী তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে দেশের পার্বত্য এলাকাগুলোতে পাহাড়ধসের আতঙ্কে ভুগছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
সকাল ৮টার দিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন কলাবাগান এলাকায় দেয়াল ধসে জেসমিন আক্তার নামে এক নারী আহত হন। তিনি ওই এলাকার খলিল মিয়ার মেয়ে। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, সকালে চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় দেয়াল ধসে এক নারী পায়ে আঘাত পান। তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অতি ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড়ধসের আশঙ্কার কথা জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার সতর্কবার্তা দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস। এই সতর্কবার্তা আগামী তিন দিনের জন্য বাড়ানো হবে বলে রোববার জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক। তিনি বলেন, বৃষ্টির ধারায় ফিরেছে দেশ। বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। আর ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই আগামী ৩ জুলাই পর্যন্ত নতুন করে পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ধসের আশঙ্কা থাকে বেশি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, নগরে ২৬টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করছে। যেখানে শিশু, বৃদ্ধসহ বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।
আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ফের বাড়ছে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি। মেঘালয় সীমান্তের কাছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার চাড়াগাঁও এলাকা দিয়ে প্রবল বেগে ঢলের পানি প্রবেশ করছে। ঢলের এই পানিতে তাহিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছে। এতে আবার বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল আলম জানান, ঢলের পানিতে খুব স্রোত থাকার কারণে যানবাহন ও মানুষ চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। যার ফলে অনেকে দুই পাশে অপেক্ষা করছেন স্রোত কমার।
বালিজুরী এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বাড়ির উঠানে হাঁটু সমান পানি চলে এসেছে। দু-দিন ভালো যায়, দু-দিন পরেই শুরু হয় দুর্ভোগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৮৭ মিলিমিটার। সুনামগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাড়ছে নদী ও হাওড়ের পানি। আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। এতে নদীর পানি আরও বাড়তে পারে।