ঢাকার বংশালের মিরনজিলস্না হরিজন কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযানের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে এ বিষয়ে হাইকোর্টের জারি করা রুল দুই মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতেও বলা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি আবেদনের শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুরাদ রেজা। অপরপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারা হোসেন ও অনীক আর হক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী উৎপল বিশ্বাস।
হরিজন কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট মামলা করেছিলেন তিন আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা, মনোজ কান্তি ভৌমিক ও উৎপল বিশ্বাস। ওই রিট আবেদনের শুনানি শেষে গত ১৩ জুন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আতাবুলস্নাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ উচ্ছেদ অভিযানের ওপর এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করে। রুলসহ ওই আদেশ বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থা না করে হরিজনদের উচ্ছেদ না করতে ডিএসসিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রুলে বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ অভিযান কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। তখন চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
এরপর হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে সিটি করপোরেশন। পরে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে 'নো অর্ডার' দেয়।
এর মধ্যেই বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এজন্য হরিজন কলোনিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ মোতায়েন করতে মঙ্গলবার সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়। পাশাপাশি স্থানীয় কাউন্সিলকে এ বিষয়ে সহায়তা করতে বলা হয়।
বুধবারই হরিজনদের পক্ষে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ মিরনজিলস্না হরিজন কলোনিতে উচ্ছেদ অভিযানের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে।
আইনজীবী মনোজ কান্তি ভৌমিক বলেন, 'হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আপিল বিভাগে একটি আবেদন করে। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ বিষয়টি হাইকোর্টে দুই মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দিয়েছেন।'
ব্রিটিশ আমলে ভারত থেকে আসা এই হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বহু বছরে ধরে এই কলোনিতে বসবাস করে আসছেন। মিরনজিলস্না সুইপার কলোনিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার মানুষের বাস।
এই কলোনির একটি অংশের আধুনিক কাঁচাবাজার নির্মাণ করতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এজন্য সেখানে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদে গত সোমবার গিয়েছিলেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তারা হরিজন সম্প্রদায়ের তীব্র আপত্তি ও বাধার মুখে পড়েন।
হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা
এদিকে, রাজধানীর বংশালের মিরনজিলস্না হরিজন কলোনির বাসিন্দাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আগামী ১৩ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে এ ঘোষণা দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাস গুপ্ত।
তিনি বলেন, 'দেশের সব নাগরিকের অধিকার সমান। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সব নাগরিককে সম-অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের অধীনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, পুনর্বাসন না করে কাউকে জোর করে উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ একটি গোষ্ঠীর মদদে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) জোর করে, হামলা চালিয়ে মিরনজিলস্নার অধিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাইকোর্টে রিট দায়ের থাকার পরও বুধবার (১০ জুলাই) ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর আউয়াল হোসেনের নেতৃত্বে দুষ্কৃতকারীরা মিরনজিলস্নাতে হামলা চালিয়েছে। কাউন্সিলরের লোকেরা মন্দির ভাঙচুর করেছে। এর জন্য আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।'
১৩ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'দেশে পুলিশ আছে, আইন-আদালত আছে, আশা করি সবাই কলোনিতে বসবাসরত হরিজনদের অধিকার রক্ষায় সংবিধানের আলোকে কাজ করবেন। আমরা মিরনজিলস্নার অধিবাসীদের বসবাসের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন চালিয়ে যাব।'
মানবাধিকারকর্মী সীমা দত্ত বলেন, '৪০০ বছর আগে হরিজনদের পূর্বপুরুষদের ভারত থেকে এই অঞ্চলে পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য আনা হয়। বর্তমানে সাত শতাধিক পরিবার এই মিরনজিলস্না হরিজন কলোনিতে গাদাগাদি করে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক পরিবারের সদস্য সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত। বাদবাকি দুই শতাধিক পরিবারের সদস্যের সবাই কোনো না কোনো সময় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের অনেকেই মারা গেছেন। কেউ বা চাকরিচু্যত হয়েছেন। এমন বাস্তবতায় অবৈধ বলে সিটি করপোরেশনে কর্মরতদের বাইরে অন্যদের উচ্ছেদ করলে পথে নামতে হবে। তাছাড়া হরিজন সম্প্রদায়ের সবার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা এই কলোনি।'
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ ও মিলন কুমার দত্ত, অ্যাডভোকেট তাপস পাল, নির্মল চ্যাটার্জি, অ্যাডভোকেট শ্যামল রায়, অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার মন্ডল প্রমুখ।
বুধবার বেলা ১২টার দিকে পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডের পাশে মিরনজিলস্না সুইপার কলোনিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুসহ অন্তত ১৬ জন আহত হন। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।