বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

নিষিদ্ধ নগরীর স্বজনেরা

গাজী তারেক আজিজ
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
নিষিদ্ধ নগরীর স্বজনেরা
নিষিদ্ধ নগরীর স্বজনেরা

সময়টা অস্পষ্ট গোলকধাঁধার। যা করতে চাই তা হয়ে উঠছে না। পারতপক্ষে আমি দিনদিন বন্ধুহীন মানুষের অবয়বে পাথরে রূপ নিচ্ছি। নিতান্তই সাদামাটা জীবন জটিল থেকে জটিল হয়ে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বারবার আমাকে ফিরে পেতে মনেপ্রাণে লড়ে যাচ্ছি তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবি, এভাবেও বাঁচা যায়! বাঁচতে হয়!

এনজিওতে চাকরির সুবাধে কিছু অজানা তথ্য উদঘাটনে যাতায়াত ছিল গণিকালয়ে। অফিসের কড়া নির্দেশ ঘুণাক্ষরেও কেউ যাতে টের না পায়। একদিকে যৌনকর্মীর দ্বারা হেনস্তা হওয়ার ভয়, অন্যদিকে চাকরি বাঁচানোর শঙ্কা। তার ওপর সাংবাদিক, থানা পুলিশ সকলকে ফাঁকি দিয়ে ছকে বাঁধা তথ্য আদায় করে নেয়া। তাও একদিনে তো নয়ই! সমুদয় তথ্য পেতে যতদিন লাগে। অফিস থেকে সময় সময় নির্দেশনা নিতে হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য গোপন জিপিএস ট্র?্যাকারই ভরসা। যাক অন্তত পক্ষে প্রাণ গেলেও লাশ উদ্ধার করা যাবে। পরিবার পরিজন সেই লাশ মিলিয়ে নিবে। কিন্তু প্রশাসন? প্রশাসন তো আর এমনি এমনি ছাড়বে না। ময়নাতদন্ত, সুরতহাল, ডিএনএ টেস্ট, ফরেনসিক টেস্ট আরো কত কি ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়! তার ওপর নিথর দেহের ভাঁজে ভাঁজে কাটাছেঁড়া করা। পরদিন মিডিয়ায় খবর বের হবে 'পতিতা পলস্নী থেকে খদ্দেরের লাশ উদ্ধার' ভয়ে শঙ্কায় শিউরে ওঠার মত অবস্থা। ভাবলে অনেক কিছু! আর না ভাবলে যেন কিছুই নয়।

আন-অফিসিয়ালি থানা পুলিশকে ইনফর্ম করা থাকে অফিস থেকে। কিন্তু মিডিয়া তো নাছোড়বান্দা! কোন কিছু একটা ঘটলে এরা তিলকে তাল বানায়। আর ধান্দা ফন্দিফিকির করেই এদের দিন চলে। যার যা কামাই করার দিন শেষে তার ওসব ছাইপাশে কিছু আসে যায় না। ওরা নগদে বিশ্বাসী! শুনেছি পুলিশও এদের হাত থেকে রেহাই পায় না! অথচ পুলিশ নিয়ে কত গালগল্পের প্রচলন যুগযুগ ধরে। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা! সেই পুলিশও নিতান্তই অসহায়। ওইসব ছ্যাঁচোড় সাম্বাদিকদের(সাংবাদিক) কাছে। তাই আমিও কম যাই না অখ্যাত এক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে ভাব জমিয়ে 'বিশেষ প্রতিনিধি' কার্ড বাগিয়ে নিয়েছি। পরে জানতে পারি ওই বেটাও ভূয়া! থাক তাতে আমার কি? আমার কার্ড হলেই হয়। অন্তত পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটা ভূমিকা রাখা যেতে পারে।

দুই.

অফিসের নির্দেশনা মত সকালে ভয়ে সংশয়ে মগবাজার রাস্তার পাশে একটা আবাসিক হোটেলের চিপা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাই। ভয়ে গা শিউরে ওঠার যোগাড়। কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না! আমি হাতে থাকা বাটন ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে যতটুকু দেখা যায় তাকিয়ে থাকি। কারো কোন রা নেই। বিল্ডিংয়ের শেষ প্রান্তের ঠিক আগের ডান পাশের রুমের ভিতর আলো জ্বলছে দেখে উঁকি দিয়ে দেখি একটা লোক উদাম গতরে ঘুমিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করলাম ঘটনা কি? হঠাৎ দেখি সেই লোকটা চোখ পিটপিট করে অনেকটা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে- কাকে চান? আমি বললাম আজ কি কেউ নেই? লোকটা বললো- কোন লোককে চান? আমি বললাম- একটু সময় কাটাব আর কি! সে বললো- সময় কাটাবেন কাটান এখানে কেন? আমি রুমে ঢুকে ইনিয়েবিনিয়ে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু সে কিছুই বুঝে উঠতে চাইলো না! সে আমাকে বসার ইঙ্গিত করে অন্যপাশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত বসে রইলাম লোকটার কখন ঘুম ভাঙে!

ততক্ষণে আমিও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে। আর কতক্ষণ সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে। এই ভেবে যখনই সেই রুম অর্থাৎ বিল্ডিং থেকে বের হব তখন শুনতে পাই পায়ের সজোরে শব্দ। কেউ যেন এই রুমের দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি কিছুটা সাহস নিয়ে দরজায় উঁকি দিতেই দেখি দশ বারোজন পুলিশ ও সাদা পোষাকের লোক। সাথে ক্যামেরা এবং মনে হচ্ছে হোটেলের লোকও আছে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম পুলিশ এখানে কেন? খুব বেশি কিছু ভাবার আগেই পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর সেই রুমে ঢুকলো। তারা নিজেদের সাথে থাকা টর্চের আলোতে এদিক সেদিক কিছু একটা কিংবা কাউকে যেন খুঁজতে লাগলো। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা লোকটাকে জাগানো চেষ্টা করে। পাশে থাকা হোটেলের কর্মচারী মত একটা লোক বলে ওঠে- স্যার এই লোকটাই গতকাল মারা গেছে। আমরা পরিচয় জানতে পারি নাই। সাথে সাথে আমিও ভূত দেখার মত করে কেঁপে উঠলাম। কি বলে এই লোকের সাথে কিছুক্ষণ আগেই আমার কথা হলো। অথচ ওরা বলছে লোকটা গতকাল মারা গেছে! কিভাবে সম্ভব। মৃত একটা লোক জীবিত হয়ে আমার সাথে কথা বলে আবার মরে যায়। তাও আমার চোখের সামনে! আমি চিন্তায় পড়ে যাই।

তিন.

আচ্ছা এই মুহূর্তে আমার নিজেকে নিজে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। এত এত পুলিশ সদস্য এখানে উপস্থিত তাদের কেউই আমাকে নিয়ে কোন কিছু ভাবছে না কেন? এই ভেবে আমিও তাদের সাথে থাকা একজন হয়ে গেলাম। বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুলিশের দলনেতার সাথে কথা বলতে চাইলাম। পুলিশ কি আমার কথা শুনছে নাকি শুনছে না কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বুঝলাম তিনি তদন্ত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছেন। কিন্তু অন্যরা কেন শুনতে চাইছে না আমার কথা। আমি বেশ কয়েকবার বোঝাতে চাইলাম এই লোক মারা যায়নি। একটু আগেই আমার সাথে তার কথা হয়েছে। তাতেও কারো আগ্রহ দেখলাম না। আমি চিৎকার করে তাদের মনোযোগ চাইলাম। কিন্তু না তারা শুনছে না। শেষমেশ আমার গলা বসে গেল। এবার যেন আরেক বিপত্তি আমার কথা আমি নিজেই শুনতে পারছি না!

পুলিশ যাবতীয় কাজ করে লোকটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত লোকটা কিছুই করছে না। অন্তত পক্ষে বাধা দিয়ে তো বলতে পারতো- আমি মরে যাই নি। বেঁচে আছি! কিন্তু লোকটা অচেতন হয়ে আছে।

পুলিশ লাশ নিয়ে ফ্রিজারে রাখলো। আমার চোখের সামনে। কি অদ্ভুত! আমিও নিজেকে ওই ফ্রীজারে আবিস্কার করলাম। কি ব্যাপার আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে? আমি আর মৃত লোকটা পাশাপাশি শুয়ে আছি!

লাশটা নামানো হলো লাশকাটাঘরে। আমিও নিজেকে দেখতে পাই সেখানে। ডোম লাশের কাটাছেঁড়া করবে বলে পাশে গিয়ে কি জানি একটা বোতল বের হরে একনাগাড়ে গিলে নিল। অভিজ্ঞ ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের তদন্ত টীম মিলে এই মুহূর্তে একটা টিম। ডোম লাশের গায়ে কুড়াল দিয়ে কোপ দিতেই আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম। এ কি আমার কেন এত ব্যথা! অসহ্য ব্যথায় ছটফট করছি। যাকে ডোম কাটছে সে নির্বিকার, নিথর। সেও কি ব্যথা পাচ্ছে? জানতে ইচ্ছে করছে! অথচ আমার কথার কোন জবাবই কেউ দিচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও কোন কূলকিনারা করতে পারছে না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিছুটা বিরক্ত। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাও হিমশীতল রুমে ঘেমে নেয়ে একাকার। বিষয়টা কি? একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কেবল বিস্ময়! আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমাকেও উদাম রাখা হয়েছে। কানেও শুনতে পাচ্ছি সকল কথা। শুধুই কথা নয় সবার নিঃশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বিলম্ব হচ্ছে দেখে পুলিশ কর্তা রুমের বাইরে যেয়ে ফোনে কারো সাথে কথা সেরে নিয়েছেন। ভিতরে এসে বললেন আপনারা একটু সরেন দেখি, বলে বাড়তি আলো জ্বালিয়ে দিলেন এবং লাশের সারা গায়ে দেখতে লাগলেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! শেষে মৃত লোকটার কলিজা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন পেয়ে গেছি! সবাই উৎসু্যক হয়ে এগিয়ে মাথা ঝুঁকে দাঁড়ালেন এবং দেখার চেষ্টা করলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন কি বুঝলেন? পুলিশ বললো লোকটার কলিজাটা দেখেছেন? ফেটে চৌচির! তাতে কি বোঝা যায়? বললেন ম্যাজিস্ট্রেট। ডাক্তার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন! কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না তখনো! পুলিশ কর্তা বললেন এই সে পুরুষ যে স্ত্রীর উপেক্ষা আর মানসিক নির্যাতনের চাপ সইতে না পেরে গণিকালয়ের নারীদের কাছে গিয়ে সুখ খুঁজে পেয়েছেন। তাকে কেউ মারেনি। সে সুখে! মহাসুখে কোমায় চলে গেছে! উপস্থিত ডোম, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার কেউই এই কথার মর্মার্থ ধরতে পারলো না। ততক্ষণে আমিও ভয়ে শুকিয়ে কাঠ! এবার আমার পালা। কেটে ছিঁড়ে শেষ করে ফেলবে। কিন্তু না কেউ আমার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহই দেখাল না। আর এতসব নাটকীয় ঘটনা দেখতে দেখতে আমিও গভীর কোমায় চলে গেলাম!

এতকিছুর পর আমার এনজিওর চাকরি! এসাইনমেন্ট এমনকি নিজেকেও কোথাও খুঁজে পেলাম না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে