শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বাখরাবাদ গ্যাসের হারানো গৌরব ফিরছে : শঙ্কর মজুমদার

# অটোমেশন কার্যক্রমে গ্রাহক সেবায় এসেছে আস্থা # রেকর্ড সংখ্যক বকেয়া বিল আদায় 
মো. আবদুল জলিল ভূইয়া, কুমিল্লা
  ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৪
বাখরাবাদ গ্যাসের হারানো গৌরব ফিরছে : শঙ্কর মজুমদার

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ত্রিবিধ দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮০ সালের ৭ই জুন ‘বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড’ নামে একটি মডেল কোম্পানী হিসেবে বাখরাবাদ গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড এর যাত্রা শুরু হয়। যা বর্তমানে ফেনী, লহ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ে বাখরাবাদ গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড নামে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যাত্রা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে অবাধে গ্যাস সংযোগ ও গ্রাহক হয়রানীর মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষন্ন হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে ভিজিল্যান্স ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমের আওতায় অবৈধ লাইন উচ্ছেদ ও গ্রাহক হয়রানী রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির হারানো গৌরব ফিরে এসেছে।

কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে শঙ্কর মজুমদার ২০২০ সালের ২৮ জুন তারিখে যোগদানের পর সকল কার্যক্রমে গতি ফিরে এসেছে।

গ্রাহকদের সেবায় তিনি চালু করেছেন হটলাইন সেবা। তাঁরই পদক্ষেপের কারণে অবৈধ সংযোগ কাজে জড়িত অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধ, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ,বকেয়া বিল আদায় এবং অটোমেশন কার্যক্রমে গ্রাহক সেবায় আস্থায় ফিরেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিস্টদের নিকট থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, এ কোম্পানীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল এর আওতাধীন এলাকায় সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অবৈধ গ্যাস লাইন চিহ্নিত করে গ্যাস লাইন উচ্ছেদ করা। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত মাত্র ৮৫.০১ কি.মি. অবৈধ গ্যাস পাইপ লাইন উচ্ছেদ ও অকার্যকর করা হয় এবং ৩৯৭১টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক শঙ্কর মজুমদার যোগদানের পর ২০২০-২১ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২৩ এ তিন অর্থ বছরে ৩৯৭.৫৬ কি:মি: অবৈধ গ্যাস সংযোগ পাইপ লাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়াও ২২ হাজার ৬২০টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অপর দিকে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের কারণে শুধু কোম্পানীর জন্ম লগ্ন হতে মাত্র ৩টি মামলা দায়ের করা হলেও ২০২১ হতে ২০২২-২৩ এ তিন বছরে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ৪১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করণে অত্র কোম্পানী বিপূল পরিমান অর্থ কোম্পানীর কোষাগারে জমা করেছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বকেয়ার কারণে ২ হাজার ১৬৫ জনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ২৪.৯৩ কোটি টাকা বকেয়া বিল আদায় করা হয়েছে এবং অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে জরিমানা আদায় হয়েছে ২.১৪ কোটি টাকা। অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে অতিরিক্ত বিল আদায় ৫ লাখ টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বকেয়ার কারণে ৩ হাজার ৮১৪ জনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ২৯.৯৪ কোটি টাকা বকেয়া বিল আদায় করা হয়েছে। এ সময়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে জরিমানা আদায় হয়েছে ৩.২৯ কোটি টাকা। একই সময়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে অতিরিক্ত বিল আদায় ৩.৯৪ কোটি টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে (১৫ জুন ২০২৩ পর্যন্ত) বকেয়ার কারণে ৪ হাজার ৫০৮ জনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ২৬.১৭ কোটি টাকা বকেয়া বিল আদায় করা হয়েছে। এ সময়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে জরিমানা আদায় হয়েছে ৩.৫৯ কোটি টাকা। একই সময়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে অতিরিক্ত বিল আদায় ১.০২ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ কাজে জড়িত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নিয়েছে বাখরাবাদ কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ প্রমানীত হওয়ায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত ১০জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকুরী থেকে অপসারণ ও ৪ জনকে পৃথকভাবে পদাবনত, ভৎসনা ও বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছে। একই সময়ে ১১টি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। ই-নথি কার্যক্রমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতায় অত্র কোম্পানিতে সংযুক্ত করা রয়েছে। এতে কোম্পানির দাপ্তরিক কাজে গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধান কার্যালয়সহ আঞ্চলিক অফিসসমূহে দাপ্তরিক কাজের শতভাগ ই-নথির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এপিএ বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির আওতায় বিজিডিসিএল ২০২১-২২ অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বিপরীতে ৯৯.৭২% স্কোর করেছে এবং পেট্রোবাংলার ১৩টি কোম্পানির মধ্যে ৩য় স্থান অর্জন গ্রাহকদের সেবায় চালু করা হয়েছে হটলাইন সেবা। গ্যাস দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য জরুরী ভিত্তিতে জানানোর জন্য ১৬৫২৩ নম্বর বিশিষ্ট হটলাইন স্থাপন করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের মে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্যাস দুর্ঘটনা, লিকেজসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে ২ হাজার ৪১০ টি কল রিসিভ করা হয়েছে এবং সকল কলই প্রতিবিধান করা হয়েছে। সকল উন্নয়ন কাজের স্বচ্ছতা আনতে ইজিপিতে টেন্ডারযোগ্য ১০০% টেন্ডার ই-জিপিতে করা হচ্ছে। বিগত সময়ে অত্র কোম্পানী ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেছে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে কুমিল্লা-নোয়াখালী ৪-লেন মহাসড়ক নির্মাণ কাজের অংশ হিসেবে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থেকে বেগমগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাসের ৪ বার ও ১০ বার চাপের ১৪.৫০ কি. মি. গ্যাস পাইপলাইন স্থানান্তর প্রতিস্থাপন নির্মাণ কাজ করেছে। ফেণী-নোয়াখালী মহাসড়কের সেবারহাট হতে চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ পর্যন্ত ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ব্যসের প্রায় ৩০.০০ কিমি পাইপলাইন স্থাপন করে। কুমিল্লা অঞ্চলের ২০টি সিএনজি স্টেশনে আইপি ক্যামেরা ও ডেটা কানেক্টিভিটি এর মাধ্যমে রিমোর্ট মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে ৪ লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকর প্রকল্পের অর্থায়নে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঘাটুরা টিবিএস হতে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নতুন জেলখানা পর্যন্ত (প্যাকেজ) অংশের ১৪.২৪ কি.মি. পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান মেসার্স আগাতা ফিড মিলস লিঃ, মেসার্স এলিট হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ও এ্যাঞ্জেল টেক্সটাইল কম্পোজিট মিলস লিঃ এ গ্যাস সংযোগের জন্য ১.৩৭ কি.মি. পাইপলাইন নির্মাণ। কুমিল্লা-নোয়াখালী ৪-লেন মহাসড়ক নির্মাণ কাজের অংশ হিসেবে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থেকে বেগমগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাসের ৪ বার ও ১০ বার চাপের ১৪.৫০ কি. মি. গ্যাস পাইপলাইন স্থানান্তর/ প্রতিস্থাপন নির্মাণ কাজ করা হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থ বছরের মে-২০২৩ পর্যন্ত আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে ৪-লেন জাতীয় মহাসড়কে প্রকল্পের অর্থায়নে আশুগঞ্জ গোলচত্ত্বর হতে ঘাটুরা টিবিএস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন নিরাপদ দুরত্বে স্থানান্তর কাজের অংশ হিসেবে ১০.২৫ কি.মি. পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে সওজ কর্তৃক আরসিসি সেচ খাল নির্মাণের কারণে মেসার্স সাফকো সিএনজি রিকুয়েন্সিং স্টেশন, মেসার্স সোপান ফিলিং স্ট্যান্ড এবং মেসার্স ফাহাদ ফিলিং স্টেশনের জন্য নতুন করে ৩টি ৪ ইঞ্চি ব্যাসের ৪ বা চাপের ০.৬৮ কি.মি. সার্ভিস পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়।

ফেনী-নোয়াখালী জাতীয় মহাসড়কের বেগমগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত ৪-লেনে উন্নীতকরণ শীর্ষক প্রকল্পের বিজিডিসিএল এর ১.৫৪ কি.মি. গ্যাস পাইপলাইন এবং ১ টি আইপি/ ডিআরএস নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে। ফেনী অঞ্চলের গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২ ইঞ্চি ব্যাসের ৮৭০ মিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে এবং এর হক আপ সম্পন্ন হয়েছে। অটোমেশন কার্যক্রমের মাধমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অত্র কোম্পানী ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কোম্পানির রাজস্ব, বিপণন এবং প্রকৌশল পরিষেবা কার্যক্রমকে একীভূত করার জন্য আইআইসিটি-বুয়েট দ্বারা তৈরি ‘বিজিডিসিএল গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এতে গ্রাহকদের নিকট হতে অনলাইনে গ্যাস বিল গ্রহণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহক অনলাইনে রেজিস্টেশন ক্রমেই বাড়ছে। আইআইসিটি, বুয়েট এর তত্ত্বাবধায়নে ২০২০ সনের এপ্রিল মাসে বিজিডিসিএল এর প্রধান কার্যালয়ে নিজস্ব ডাটা সেন্টার ও ডেটা ডিজাস্টার রিকভারী সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

কোম্পানির বিদ্যমান কন্ট্রাকটরের লাইসেন্স নবায়ন কিংবা লাইসেন্সের জন্য আবেদন, ডকুমেন্ট আপলোড ইত্যাদি কার্যক্রম অনলাইনে সম্পাদনের জন্য বিজিডিসিএল কন্ট্রাকটর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' চালু রয়েছে। এ কার্যক্রমের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ‘বিজিডিসিএল কন্ট্রাকটর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ সফটওয়্যার এর আইডিয়াটি জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত (তৃতীয় স্থান) হয়। বর্তমানে গ্রাহকেরা ঘরে বসে অনলাইনে তার বিলের স্ট্যাটাস, পরিশোধ সম্পর্কিত তথ্যাদি, প্রত্যয়ন ডাউনলোড ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য গ্রাহক পোর্টাল (http://customer bgdcl.gov.bd ) চালু করা হয়েছে।

কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শঙ্কর মজুমদার জানান, গ্রাহক সেবায় অত্র অতিষ্ঠান অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কিনা সেটা গ্রাহকরাই বিচার করবেন।

তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে কোম্পানীর গ্যাস লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। এতে যদি আমাদের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ। এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ জন্য জনগনের সচেতনতা ও সহযোগিতাও আমাদের দরকার।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে