শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধিক ফলন পেতে মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি

কৃষিবিদ রবিউল হক
  ১৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার খাওয়া প্রয়োজন তেমনি সব গাছেরও খাবারের প্রয়োজন হয়। গাছের জন্য যেসব খাবারের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে কিছু গাছ নিজেই তৈরি করতে পারে। বাকিগুলো শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু হতে কার্বন ডাই- অক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। ক্রমাগতহারে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার দেয়া দরকার। একজন কৃষক ৩০/৪০ বছর ধরে চাষ করছেন বছরের পর বছর একটার পর একটা ফসলের চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। প্রতিটি চাষের সময় নানা রকমের রাসায়নিক সারের ব্যবহার করছেন। মাঝে মধ্যে জৈবসারও দেয়া হচ্ছে যদিও তা প্রয়োজনের চেয়েও কম মাত্রায়। বেশিরভাগ কৃষকবন্ধু জৈবসার ব্যবহার কম করে থাকেন, ফলে মাটির চরিত্র পাল্টাচ্ছে। অধিক মুনাফা করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও বিষের ব্যবহার করছেন। দিনের পর দিন এভাবে চলার ফলে জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে, ফলে ফলন কম হচ্ছে।

মাটির স্বাস্থ্য মানে কি : যে মাটিকে কেন্দ্র করে চাষাবাদ করা হচ্ছে তার স্বাস্থ্যের খবর রাখা হচ্ছে না। এর জন্য দরকার মাটি পরীক্ষা করা। মাটি পরীক্ষা করলে জানা যাবে কি কি খাদ্যোপাদান কি পরিমাণে আছে। এমনও দেখা যায়, বছরের পর বছর মাত্রানুযায়ী নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম জমিতে দেয়া হচ্ছে- কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেল ফসফেটের মাত্রা হাই, পটাশের মাত্রাও অনেক বেশি- আবার অন্যান্য খাদ্যোপাদানের মাত্রা বেশ কম রয়েছে। কৃষক কিন্তু ফসল অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় মাত্রায় সারের ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পোড় জানা গেল বেশ কিছু সারের অপব্যবহার হয়েছে। তাই প্রত্যেকটি জমির বছরে অন্তত একবার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। এর ফলে শুধু সারের অপব্যবহারই কমবে তাই নয়, সেইসঙ্গে বেশি মাত্রায় বারবার সার ব্যবহারে জমিতে সেইসব খাদ্যগুণ জমে অন্য খাদ্যকেও অগ্রহণযোগ্য করে দেয়। বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমতে থাকে ফলে ফসলের ফলন কমে যায়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য জানার পর সারের ব্যবহার করলে শুধুমাত্র যে অর্থের সাশ্রয় হবে তা নয়- মাটি অ জমি বাঁচবে। যখন জানা যাবে মাটিতে জৈবের উপস্থিতি তলানিতে থেকেছে তখন মাটি ও ফসল বাঁচাতে কৃষক উঠেপড়ে লাগবে।

কৃষি পরিবেশ অঞ্চল অনুসারে মাটির বিচিত্রতা : বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশের বৈচিত্র্যতা আছে। এ বৈচিত্র্যতা শুধু অঞ্চলভিত্তিক নয়, এর বিস্তৃতি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়েও বিদ্যমান। ভূমির উত্তম ব্যবহার এবং কৃষির সঠিক পরিকল্পনার জন্য ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এবং ৮৮ উপ-অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই মাটির পুষ্টি উপাদান সব জায়গায় এক রকম নয়। এ জন্য মাটি পরীক্ষা করে সার দেয়া উপকারী। আমাদের দেশের চাষাবাদ কৌশল, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের মাটিতে পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমছে। আর এ অসুবিধা দূর করার জন্য পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সারের অপচয় রোধ তথা পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় ফসলের চাহিদাভিত্তিক সার প্রয়োগ করতে হবে।

আমরা জানি, যে কোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যে সব খাদ্যোপাদানের দরকার হয় তার মধ্যে ১৭টা খাদ্যোপাদান অত্যন্ত জরুরি, যদিও ১৭টি খাদ্যোপাদানের বাইরে আরো অনেক উপাদান আছে, তবে সেগুলো বিশেষভাবে জরুরি নয়। ১৭ টি খাদ্যোপাদানের মধ্যে মাত্র ৩টি খাদ্য প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ পেয়ে থাকে। কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন যা বায়ু থেকে পাওয়া যায়। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাগনেসিয়ামকে ম্যাক্রো বা প্রাথমিক জরুরি খাদ্য বলা হয়। এ ছাড়া অনুখাদ্য হিসেবে লোহা, বোরন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, তামা, মলিবডেনাম, নিকেল ইত্যাদিও উদ্ভিদ মাটির থেকে খনিজ লবণের সঙ্গে গ্রহণ করে থেকে। সারা বছর জমিতে নানান ফসলের চাষের ফলে কোনো খাদ্যের অভাব হচ্ছে তা জানতে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।

কীভাবে মাটি সংগ্রহ করবেন : মাটির স্বাস্থ্যকে সঠিকভাবে জানতে হলে মাটি সংগ্রহের কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি জানতে হবে, তা না হলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না। আসুন জেনে নিই কীভাবে মাটি সংগ্রহ করবেন? জমিতে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি স্থান নির্বাচন করতে হবে। মোটামুটি একবিঘা জমিতে ১০-১২টা স্থান (ঝঢ়ড়ঃ) নির্বাচন করলে ভালো হয়। জমির আল থেকে কম করে ২ হাত ছেড়ে স্থান নির্বাচন করতে হবে। জমিতে ফসল থাকলে সেই জমির নমুনা সংগ্রহ না করাই ভালো, তবে জরুরি প্রয়োজনে মাটির নমুনা সংগ্রহ করলে দুই সারির মাঝামাঝি স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করা যেতে পারে। জমির অবস্থান যদি ঢালু হয় তাহলে নিচের দিকে ২ হাত ছেড়ে ও উঁচুর দিকেও ২ হাত ছেড়ে নমুনা সংগ্রহের স্থান নির্বাচন করা উচিত। জমিতে যদি গাছ থাকে তাহলে ছায়াযুক্ত স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। সদ্য ব্যবহৃত জৈব বা অজৈব সার যে জমিতে দেয়া হয়েছে, সেখানকার মাটি পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা যাবে না। মাটির নমুনা সংগ্রহ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম- কোদাল, খুরপি, বালতি, পুরনো খবরের কাগজ ইত্যাদি।

কতটা গভীর করে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে : প্রথমেই বলেছি বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি স্পট নির্বাচন করতে হবে। বিঘাতে ১০/১২টা স্থানে হলে খুব ভালো হয়। এবার যদি জমিতে আগাছা থাকে তাহলে কোদাল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর কোদাল দিয়ে খাঁড়াভাবে কোপ মারতে হবে যাতে ৬-৯ ইঞ্চি গভীরে কোদাল চলে যাবে। এবার কোদাল তুলে উল্টোদিকে কাত করে এমনভাবে কোদাল মারতে হবে যাতে (ঠ) ভি-আকৃতি বিশিষ্ট হয়। এই ভি আকৃতির মাটি তুলে পাশে রাখতে হবে। এবারে খুপরি বা নিড়ানি দিয়ে খাঁড়াভাবে কাটা অংশে ১-১.৫ ইঞ্চি মাটি কেকের মতো ওপর থেকে নিচ অবধি কাটতে হবে। এই কাটা অংশের মাটি যেন সব স্তরের থাকে। এখান থেকে কেবল মাত্র কেকের পিসের মতো মাটি সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে প্রতিটি 'ঠ' আকৃতির কাটা গর্তে ১ পিস মাটি সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে ১০/১২টি নমুনা বালতিতে রাখতে হবে। সব মাটির ওজন কমবেশি ২ কেজির মতো হবে। কিন্তু পরীক্ষাগারের জন্য ২০০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম মাটি লাগবে।

সংগ্রহ করা মাটি যদি বেশি আর্দ্রতা থাকে তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে খবরের কাগজের ওপর রেখে ২/৩ দিন শুকাতে হবে। তারপর সব মাটি ভালোভাবে গুঁড়ো করতে হবে। এসব আগাছার শিকড়, ঘাস, পাথর ইত্যাদি বাছতে হবে। এবারে সব মাটি এক জায়গায় রেখে গোল করে বিছানো হবে। এবার হাত দিয়ে যোগচিহ্নের মতো ভাগ করতে হবে, কোনাকুনি যে কোনো ভাগ রেখে বিপরীত ভাগের মাটি বাদ দিতে হবে- এভাবে ৩/৪ বার ভাগ করলে ৩০০ গ্রামের মতো পরিমাণ হবে যেটা পরীক্ষা করার জন্য রাখতে হবে। পলিথিনের প্যাকেটে মাটি ভরে প্রতিটি নমুনায় কাগজে জমির পরিচিতি, কৃষকের নাম ঠিকানা, কোন ফসল ছিল, কি ফসল চাষ করবেন ইত্যাদি সাদা কাগজে বিস্তারিত লিখতে হবে। এই কাগজের লেখা দুই কপি করতে হবে। ১ কপি নমুনার প্যাকেটের ভেতরে থাকবে অন্যটি প্যাকেটের বাইরে থাকবে। উলেস্নখ থাকে যে, জমির পরিচিতি অর্থ- মৌজা, খতিয়ান, দাগ নং, জমির অবস্থান ইত্যাদি লেখা থাকবে যাতে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়- কোন জমির মাটি।

মাটি পরীক্ষাগারে কি কি পরীক্ষা করা হয় : মূলত মাটির অম্স্ন/ক্ষারের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। অনুখাদ্যের পরিমাণ জানতে আর আধুনিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা যেতে পারে। বর্তমানে প্রতিটি বস্নকে ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে- এখানে মাটি পরীক্ষা করা যেতে পারে। বস্নকের অউঅ বা কচঝ দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে সহজেই মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দরকার মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে কৃষককে এগিয়ে আসার।

লেখক: কৃষি প্রশিক্ষক, কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্র,

রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, নরেন্দ্রপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<41229 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1