শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফলন বাড়াতে গাছের অঙ্গ ছঁাটাই

খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম
  ১২ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
ফল গাছে প্রচুর পরিমাণে ফুল-ফল উৎপাদনক্ষম শাখা-প্রশাখার সংখ্যা বাড়ানো এবং ফলের গুণগতমান বৃদ্ধি করতে ছঁাটাইয়ের বিকল্প নেই

বাংলাদেশের শহর-নগর-গ্রামে যেদিকেই তাকানো যায় ফলের গাছ চোখে পড়বেই। এসব গাছের অধিকাংশই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা। খুব কমসংখ্যক ফলগাছ অঙ্গ ছঁাটাইয়ের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধির সুযোগ পায়। ফলগাছ রোপণই আসল কথা নয়। রোপণ থেকে শুরু করে ফল ধারণ পযর্ন্ত ফল গাছের বিভিন্ন অঙ্গ ছঁাটাই ফল গাছ ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম কাজ। মূলত দুটি উদ্দেশ্যে ফল গাছের অঙ্গ ছঁাটাই করা হয়ে থাকে। প্রথমত, অফলন্ত ফলগাছকে একটি নিদির্ষ্ট আকার আকৃতি দেয়া, দ্বিতীয়ত, অফলন্ত ও ফলন্ত ফলগাছের অপ্রয়োজনীয় দুবর্ল, চিকন, নরম, ভাঙ্গা ও মরা ডাল-পালা এবং রোগ ও পোকা আক্রান্ত ডালপালা ছঁাটাই করে গাছের ভেতরের দিকে আলো-বাতাস চলাচল স্বাভাবিক রাখা। এ দুটি উদ্দেশ্য ছাড়াও আরো কিছু কারণে ফল গাছ ছঁাটাই করতে হয়। যেমন-

* ফলগাছটি যদি মাতৃর্গাছ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ফলগাছ থেকে বেশি পরিমাণে সায়ন উৎপাদন করা

* ফল গাছে প্রচুর পরিমাণে ফুল-ফল উৎপাদনক্ষম শাখা-প্রশাখার সংখ্যা বাড়ানো এবং ফলের গুণগতমান বৃদ্ধি করা

* ঝড় বা প্রবল বাতাসে যেন ফলগাছ সহজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য গাছকে সুগঠিত ও মজবুত অবকাঠামো প্রদান করা

* ফল গাছের বিভিন্ন পরিচযার্ যেমন- বালাইনাশক স্প্রে করা, সায়ন সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজ সহজ করা

* যেসব ফল গাছে ফল ধারণ সমস্যা আছে, সেসব গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে নতুন শাখা-প্রশাখা গজানোর ব্যবস্থা করা

* এক বছর পর পর যেসব গাছে ফল ধরে সেসব গাছের একান্তর ক্রমিক ফলনের প্রভাব কমানো বা ফল ধরার ব্যবস্থা করা

* যেসব শাখা-প্রশাখা অন্য শাখা-প্রশাখার ভেতরে ঢুকে যায় বা নি¤œমুখী হয় সেগুলো ছঁাটাই করে গাছকে ঝোপালো অবস্থা থেকে মুক্ত রাখা

ফল গাছের বিভিন্ন অঙ্গ যেমনÑ ডাল, পাতা, ছাল বা বাকল, ফুল, ফল ও শিকড় বিভিন্ন কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন ফল গাছের বিভিন্ন বয়সে জাত ও বৃদ্ধির স্বভাব অনুযায়ী ছঁাটাই করতে হয়। ফল ধরার আগেই ফল গাছের কাঠামোগত আকৃতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে গাছের শীষর্ ছঁাটাই করে গাছকে খাটো রাখা। এতে গাছে সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান, স্প্রে করা এবং সহজে ফল সংগ্রহসহ অন্যান্য পরিচযার্ করা যায়। এ ছাড়া গাছে যদি ৪ থেকে ৭টি শাখা-প্রশাখা থাকে তাহলে গাছ যান্ত্রিকভাবেও দৃঢ় ও খোলা-মেলা হয়। গাছের ভেতরের দিকে এমন কিছু শাখা-প্রশাখা গজায় যেগুলো থেকে কোন ফলন পাওয়া যায় না, সেগুলোও ছঁাটাই করা উচিত। কোন কোন ফল গাছের গোড়ার দিকে কিছু কিছু কুশি বা নতুন শাখা বের হতে দেখা যায়, সেগুলো নিয়মিতভাবে ছঁাটাই করতে হয়। যেমন- ডালিম, পেয়ারা, লেবু ও কঁাঠাল গাছের গোড়ায় দুই-তিন সপ্তাহ পর পর বের হওয়া কুশিগুলো ছঁাটাই করতে হয়।

ছঁাটাই করার সময় লক্ষ্য রাখতে হয়, গাছের সতেজতা কেমন, বয়স কত এবং জাত ও বৃদ্ধির স্বভাব কেমন। কম বয়সী ফল গাছে যথাসম্ভব কম ছঁাটাই বা হালকা ছঁাটাই করতে হয়। তবে কম বা বেশি যে বয়সেরই হোক না কেন গাছে মরা বা ডাঙ্গা এবং রোগ-পোকা আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা ছঁাটাইয়ের সময় কিছুটা সুস্থ অংশসহ ছঁাটাই করতে হয়। মূল কাÐ এবং মোটা শাখা কখনোই ছঁাটাই করা ঠিক নয়।

বড় মোটা শাখা কাটার সময় নিদির্ষ্ট জায়গা থেকে প্রায় ১ ফুট বা ৩০ সেন্টিমিটার দূরে নিচের দিক থেকে কাটা শুরু করতে হয়। কাটার গভীরতা নিভর্র করে কতির্ত শাখার অংশ নিচের দিকে বেঁকে আসা পযর্ন্ত। এর পর শাখার উপরের দিকে প্রথম কাটার স্থান থেকে ১ ইঞ্চি বা আড়াই সেন্টিমিটার দূরে দ্বিতীয় কাটা দিতে হয়। এতে কাটা শাখা বাকল বা ছালের সাথে ঝুলে থাকে না। কাটা জায়গায় আলকাতরা বা ছত্রাকনাশক লাগাতে হয়। চিকন শাখাও নিচের দিক থেকে কাটলে অকতির্ত অংশের ছাল বা বাকল উঠে আসে না। কাটার সময় সুস্থ-সবল কুঁড়ি বা পবর্সন্ধির ঠিক উপরেই শাখা কাটা উচিত। তবে গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য শাখার কুঁড়ি বা পবর্সন্ধির নিচেই কাটতে হয়।

ফল গাছ ছঁাইয়ের জন্য নিদির্ষ্ট সময় ও মৌসুমের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হয়। কারণ অসময়ে ছঁাটাই করলে সুফল পাওয়ার বদলে গাছে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফলন নাও পাওয়া যেতে পারে। বষার্র শেষে এবং শীতের আগে ফল গাছে ছঁাটাই করা উচিত। তবে ফল সংগ্রহের পরই ছঁাটাই করা সবচেয়ে ভালো। গাছে ফুল আসার আগে আগে বা ফল ধরা অবস্থায় শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই করা ঠিক নয়। তবে নিদির্ষ্টসংখ্যক ফলধারণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত ফুল ও ফল ছঁাটাই করা যেতে পারে। এ ছাড়া খরা, দীঘর্ শুকনো মৌসুম বা শীতের সময় কখনোই ছঁাটাই করা উচিত নয়। বষার্র সময় বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে ছঁাটাই না করাই ভালো।

বাংলাদেশে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফল পাওয়া যায়। এসব ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর অথবা শীতের আগেই অথবা যদি প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে অঙ্গ ছঁাটাই করা হয়। এতে সুস্থ-সবল ফল গাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কয়েকটি জনপ্রিয় ও প্রচলিত ফলগাছের অঙ্গ ছঁাটাই সম্পকের্ সবারই কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল আম। বাগান আকারে ছাড়াও গ্রামে এবং অনেকের বাড়িতেই ছোট-বড় জাতের আম গাছ চোখে পড়ে। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ছঁাটাই এবং অন্যান্য পরিচযার্ করলে এসব আম গাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। জুন মাস থেকে আগস্ট মাস পযর্ন্ত সময়ে আম সংগ্রহের পরপরই বেঁাটার উপরের কিছুটা অংশসহ গাছ থেকে বেঁাটা ছঁাটাই করে ফেলা উচিত। এতে নতুন যে শাখা গজায় তার বয়স ৬-৭ মাস বয়স হলেই পরের মৌসুমে মুকুল আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া রোগ ও পোকা আক্রান্ত, মরা, আধামরা, দুবর্ল-চিকন শাখা ছঁাটাই করতে হয়। গাছের নিচের আগাছা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোদাল দিয়ে হালকা করে কোপালে কিছু কিছু শিকড় কাটা পড়ে। এতে আম গাছের একান্তর ক্রমিক ফল ধারণ সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সী আম গাছে বেশি ছঁাটাই করলে কলম করার জন্য ভালো সায়ন পাওয়া যায়।

জুলাই-আগস্ট মাসে কঁাঠাল সংগ্রহের পর কঁাঠাল গাছের দুবর্ল, মরা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই করতে হয়। সেই সঙ্গে ফলের বেঁাটা এবং কাÐ ও গোড়া থেকে বের হওয়া নতুন শাখা ছঁাটাই করতে হয়। অনেকেই ছাগলের খাদ্য হিসেবে বছরের যে কোনো সময়ই কঁাঠাল পাতার জন্য ছোট ছোট ডালসহ ছঁাটাই করে থাকেন। এতে গাছের খাদ্য উৎপাদন কমে যায় ও গাছ দুবর্ল হয়ে ফল ধারণও কমে যায়।

লিচুর ফল সংগ্রহের সময় সাধারণত কিছুটা শাখাসহ ভাঙা হয়। কারণ লিচুর ফুল ফোটা অনেকাংশই নিভর্র করে নতুন শাখা-প্রশাখার ওপর। তবে চায়না-৩ জাতের বেলায় বেশি শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই না করা ভালো। কারণ এ জাতটির নতুন শাখা-প্রশাখায় আমাদের দেশের আবহাওয়ায় খুব বেশি ফুল-ফল ধরে না। এ জন্য দুবর্ল, মরা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই করা ছাড়া চায়না-৩ জাতের লিচু সংগ্রহের সময় যতটা সম্ভব কম শাখা-প্রশাখা ভাঙা উচিত।

লেবুর কলম বা চারা রোপণের পরবতীর্ এক বছর পযর্ন্ত ২-৩ মাস পর পর শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই করে পাতলা করে দিতে হয়। ফল সংগ্রহ করার পর ফলন্ত শাখা-প্রশাখাগুলো ছঁাটাই করে দিলে নতুন গজানো শাখায় পরের মৌসুমে বেশি ফলন পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২-৩ সপ্তাহ পর পর গাছের গোড়ার কুশি এবং গাছের দুবর্ল, শুকনো বা মরা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা ছঁাটাই করতে হয়।

নারিকেল গাছের উপরের দিকে পুষ্পমঞ্জরির সঙ্গে যে জালের মতো বাদামি অংশ থাকে সেগুলো শুকিয়ে গেলে বা রোগ-পোকার আক্রমণ হলেই পরিষ্কার করতে হয়। নারিকেল গাছের সবুজ পাতা এবং পুষ্পমঞ্জরির জাল কখনোই কেটে ফেলা উচিত নয়। গাছে যদি ফল সংখ্যা বেশি হয়, তাহলে চার মাস বয়সের কিছু কচি ডাব পাতলাকরণ পদ্ধতিতে ছঁাটাই করে দিতে হয়। এতে বাকি ফলগুলো ভালোভাবে বড় হওয়ার সুযোগ পায়। বষার্র আগে বা পরে গাছ পরিষ্কার করতে হয়।

প্রাকৃতিকভাবেই পেয়ারা গাছ ঝোপালো হয়। এ জন্য মূল কাÐ ছাড়া গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া শাখা কেটে দিতে হয়। ফল সংগ্রহের পর শাখা-প্রশাখাগুলোর আগা ছঁাটাই করতে হয়। গাছের অন্য শাখা-প্রশাখাও এমনভাবে ছঁাটাই করতে হয় যেন দুপুর বেলা গাছের নিচে কিছু আলো কিছু ছায়া পড়ে।

অঙ্গ ছঁাটাইয়ের মাধ্যমে ফল গাছকে সুস্থ-সবল রেখে বেশি পরিমাণে ফলন পাওয়া সম্ভব। এ জন্য বিভিন্ন ফলের জাত ও বয়স অনুয়ায়ী কখন কিভাবে অঙ্গ ছঁাটাই করলে গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও ফল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়, সে সম্পকের্ আরও বিস্তারিত পরামশের্র জন্য নিকটস্থ কৃষি অফিস বা হটির্কালচার সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

রংপুর অঞ্চল, রংপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<7552 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1