শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাবিনবিহীন বিয়ে, প্রতারণা ও আমাদের আইন

‘কাবিন নিবন্ধনের পরিবতের্ কোটর্ ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী’Ñ এ ভুল ধারণার ফঁাদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোটর্ ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০৩ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

রহিম ও রুনা (ছদ্মনাম) একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসে। ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে ওরা পরিবারের অমতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রেমের টানে রহিমের হাত ধরে ঘর ছাড়ে রুনা। উভয়ের গন্তব্য ঢাকা। ওদের ধারণা কোটের্ উকিলের মাধ্যমে বিয়ে করতে হয়। সুযোগসন্ধানী এক শ্রেণির উকিলও এ কাজে সহায়তা করে থাকে। আদালতের নোটারি পাবলিকের কাযার্লয়ে গিয়ে ওরা ‘কোটর্ ম্যারেজ’ করে। কিন্তু তখন তারা বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি করেনি। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই ওদের দাম্পত্য জীবনে কলহ শুরু হয়। রহিম রুনার সঙ্গে তার বিয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। আর এ অজুহাতে রুনাকে মোহরানা, খোরপোষ ও দাম্পত্য অধিকার দিতেও তিনি রাজি নন। অবশেষে বিষয়টি গড়ায় আদালতে। বিয়েটা প্রমাণ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় রুনাকে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, মৃতের সন্তানদের উত্তরাধিকার, খোরপোষ ও মোহরানার অধিকার থেকে ওই নারীকে বঞ্চিত হতে হয়। এ ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন বিয়ে যদি রেজিস্ট্রি করা হয়। সুতরাং বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একজন নারী তার দাম্পত্য জীবনের অনেক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন এবং অসহায়ত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।

১৯৭৪ সালের মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনে (সংশোধিত ৮ মাচর্, ২০০৫) বলা হয়েছে যে, যদি কেউ বিয়ে রেজিস্ট্রি না করেন তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন এবং এ অপরাধের জন্য আইন কতৃর্ক নিধাির্রত শাস্তি হচ্ছে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদÐ অথবা আথির্ক জরিমানা যা তিন হাজার টাকা পযর্ন্ত হতে পারে অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে।

কাবিন রেজিস্ট্রির পরিবতের্ কোটর্ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী এ ভুল ধারণার ফঁাদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোটর্ ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই। ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কাযার্লয়ে কিংবা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাযার্লয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী কাবিন রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে।

বিশেষ কয়েক শ্রেণির নারী-পুরুষের মধ্যে এরকম বিয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তন্মধ্যে গামের্ন্ট শ্রমিক, যৌনকমীর্ এবং বিশেষ প্রেম-ঘটিত তরুণ-তরুণী। আবেগঘন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীর ভুল ধারণা হয় যে, শুধু এফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত হয়। কাজী অফিসে বিয়ের জন্য বিরাট অঙ্কের ফিস দিতে হয় বলে কোটর্ ম্যারেজকে তুলনামূলক ভালো মনে করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির নারী-পুরুষ। অন্যদিকে যৌনকমীর্রা অনেক সময় ঠিকানা বদল করে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অবস্থানের সুবিধার কথা বিবেচনা করে কোটর্ ম্যারেজে উৎসাহ হয় অধিক। অনেকে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে একাধিক বিয়ের কথা গোপন করার জন্য। কোনো মেয়ের অভিভাবককে জিম্মি করে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যও অনেক সময় এফিডেভিটের মাধ্যমে ভুয়া বিয়ের দলিল তৈরি করা হয়। এ দলিল তৈরি করা খুব সহজেই সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে হলফনামা প্রাথীের্ক নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয় না। এর ফলে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নিযার্তন মামলা থেকে রক্ষার জন্য আসামি পক্ষের এরকম হলফনামা তৈরির প্রবণতা দেখা যায়।

মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, সনাতন ধমের্ বিশ্বাসী সাথী ও বিদ্যুৎ (ছদ্মনাম) এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। তাদের সংসারে একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরস্পর তাদের দাম্পত্য জীবন বেশিদূর এগোয়নি। পরে তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে নোটারি পাবলিকের কাযার্লয়ে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন। হলফনামাটি একটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধন করে। কিন্তু বিয়ে বিচ্ছেদের এ ধরনের দলিল রেজিস্ট্রি করা ও এফিডেভিট করা সম্পূণর্ বেআইনি। হিন্দু আইনে বিয়ে বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে হবে পারিবারিক আদালতে। খ্রিস্টান আইনেও বিয়ে একটি চুক্তি, যা ভঙ্গ করা যায় না। ১৮৬৯-এর বিয়ে বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী খ্রিস্টান ধমার্বলম্বীরা বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যেতে পারেন।

বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নিধাির্রত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়েসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সম্পকের্ আইনগত দলিল যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। আইনানুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যায়। এ ছাড়া কাবিননামার সব কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্য ব্যক্তিদের স্বাক্ষর দিতে হয়।

ইসলাম ধমের্ বিয়ে নিবন্ধন আইন থাকলেও হিন্দু ধমার্বলম্বীদের ক্ষেত্রে বিয়ে নিবন্ধন আইন ছিল না। হিন্দু ধমার্বলম্বীদের বিয়ে নিবন্ধনের বিধান ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন তৈরি হওয়ায় এখানেও অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বতর্মানে বিদেশ ভ্রমণ, অভিবাসন, চাকরি, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিয়ে সম্পকির্ত দালিলিক প্রমাণ একটি অপরিহাযর্ বিষয়। প্রতারণার সুযোগ বন্ধ করা এবং হিন্দু নারীদের সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা সৃষ্টির লক্ষ্যে হিন্দু বিয়ে আইন ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করা সমীচীন।

কাবিনবিহীন বিয়ে প্রমাণে একটি কেইস স্টাডি : মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন একে অন্যকে ভালোবাসেন। সে সূত্র ধরে দুজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘর-সংসার করতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ের কোনো কাবিননামা রেজিস্ট্রি হয়নি। একপযাের্য় লোভী আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছে যৌতুক দাবি করে নিযার্তন করে এবং যৌতুক না পাওয়ায় মমতাজ বেগমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মমতাজ বেগম তার ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকে দেন। কিন্তু বিধিবাম! আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে কে অস্বীকার করে আদালতে জবাব দাখিল করে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। এদিকে মমতাজ বেগম দাবি করেন, তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা দীঘির্দন স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই একত্রে বসবাস করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেয়, তাদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। পারিবারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোটর্ বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোটর্ বিভাগের একটি একক বেঞ্চ ১৯৯৯ সালে পারিবারিক আদালতের আদেশটি খারিজ করে দেন। হাইকোটর্ বিভাগ তার রায়ে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূণর্ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যথর্ হয়েছেন। হাইকোটর্ বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয়।

আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে ২০০৩ সালে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া। সিভিল আপিল নাম্বার-১৩৯/২০০৩। তিনি আপিলে দাবি করেন, কাবিননামার অনুপস্থিতিতে বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না এই মমের্ হাইকোটর্ বিভাগের বিবেচনা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং তা আইনের সঠিক মমর্ নয়। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে আপিল বিভাগ মমতাজ বেগমের পক্ষে রায় দেয়। মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এসকে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীঘির্দন বসবাস করেন এবং তাদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে। সুতরাং কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে