বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক বাংলাদেশি নাজমুন

রুমান হাফিজ
  ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
নাজমুন নাহার

মানসিক হতাশা কিংবা সামাজিক কোনো বাধাই নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়া রুখতে পারে না। নারী যদি সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নেয় তাকে কেউ আটকাতে পারে না। তেমনি বাধা না মানা এক নারী পরিব্রাজক নাজমুন নাহার।

তিনি শুধু পরিব্রাজকই নন, তিনি বাংলাদেশের পতাকা বহনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব শান্তির বাতার্ পৌঁছে দিচ্ছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তিনি বিশ্বাস করেন পুরো পৃথিবী একটি পরিবার। নাজমুন নাহারের জীবন ও গত আঠারো বছরের দুদার্ন্ত ভ্রমণকাহিনীকে পযাের্লাচনা করলে দেখা যায়, দেশাত্মবোধে জাগ্রত প্রেরণাময়ী নারী তিনি। বাধা-বিপত্তি, কষ্ট, সব কিছুকে উপেক্ষা করে যিনি ছুটছেন লাল সবুজের পতাকা হাতে পৃথিবীর পথে পথে। চলুন জেনে নেই বিশ্বজয়ী এই পরিব্রাজক সম্পকের্Ñ

অনেকেই ভ্রমণ করেন, কিন্তু নাজমুনের ভ্রমণ এডভেঞ্চার নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। তিনি শুধু এক দেশ থেকে আরেক দেশে বিমানে ফ্লাই করেই যাত্রা শেষ করেন না। তিনি হাজার হাজার মাইল বাই রোডে জানির্ করেছেন পৃথিবীর এক দেশ থেকে আরেক দেশে। তিনি সেইলিং বোটে করে পার হয়েছেন সমুদ্র থেকে সমুদ্র। ভ্রমণ করেছেন অনেক দ্বীপ-দেশ। সমুদ্রের গভীরে গিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে। আজ তিনি হয়ে উঠেছেন তরুণ জাগরণের পথিকৃৎ। নাজমুন নাহারের ভ্রমণ ঝুড়ির সংখ্যা এখন একশ আট! সম্প্রতি তিনি ঘুরে এসেছেন সেন্ট্রাল এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকে।

লাল সবুজের পতাকা হাতে চলছেন দুবার্র গতিতে। বুকে তার বাংলাদেশ। হাতে লাল সবুজের পতাকা। বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি বাংলাদেশের কথা। মানবতার কথা। বিশ্ব শান্তির কথা। তিনি বিশ্বাস করেন ‘ওয়ান আথর্ ওয়ান ফ্যামেলি।’

নাজমুন নাহারের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ল²ীপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ৫ বোন, ৩ ভাইয়ের মধ্যে নাজমুন সবার ছোট। স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে তিনি পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

শুরুর দিকটা জানতে চাইলে নাজমুন নাহার বলেন,

‘২০০০ সালে ভারতে ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়! সে সময় ভারতের ভ‚পালের পঁাচমারিতে যাই। এটিই জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ! বিশ্বের আশিটি দেশের ছেলেমেয়ের সামনে তখনই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সুযোগ হয়। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিশ্ব যাত্রা করার স্বপ্ন দেখতে থাকি।’

ভ্রমণ অভিজ্ঞতার নানারকম গল্প হয় নাজমুন নাহারের সঙ্গে।

দিনে রাতের অন্ধকারকে একাকার করে পবের্ত, সমুদ্রের তলদেশে, দুগর্ম জঙ্গলে, বন্যপ্রাণীর পাহাড়ে, অজানা আদিবাসীদের এলাকায় কোথাও যেতে ভয় পাননি তিনি। বুকে তার লাল সবুজের শিহরণ, দুচোখে তার বিশ্ব। একজন নারী হিসেবে একাই শতাধিক স্বাধীন দেশ ঘুরে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নাজমুন নাহার।

তার এই মাইলফলককে সম্মাননা দিয়েছেন জাম্বিয়া সরকারের গভনর্র হ্যারিয়েট কায়েনা। জাম্বিয়া সরকারের গভনের্রর কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ফ্ল্যাগ গালর্’ উপাধি। তাছাড়া বিখ্যাত আন্তজাির্তক মিডিয়া ‘জাম্বিয়া ডেইলি মেইল’ এর বিশেষ ক্রোড়পত্রে ৩ জুন ২০১৮ প্রকাশিত হয় একটি ফিচার স্টোরি। খ্যাতনামা সাংবাদিক মাগাের্রট সামুলেলা তার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন নাজমুনের জীবনদশর্ন, বাংলাদেশের পতাকার সম্মান, ভ্রমণ মাইলফলকের কাহিনী ও তার মোটিভেশনাল কাযর্ক্রমের কথা।

নিজের জীবন দশের্নর কথা যেমনটা বলছিলেন, ‘আমি যখন ভাবি মহাকাশের অন্য গ্রহ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে পৃথিবীকে মনে হয় একটা বøু ডট! এই বøু ডট মহাশূন্যের মধ্যে ভাসমান একটি গ্রহ, যার নাম পৃথিবী, যেখানে আমরা বসবাস করি। বিভাজন করি মানুষে মানুষে। অল্প সময়ের জন্য আসা এই পৃথিবীতে ভেদাভেদে মেতে উঠি, কিন্তু একবার যখন আমরা চিন্তা করতে পারব কি নিয়ে এসেছি এই পৃথিবীতে কি নিয়ে যাব তখন আমার মনে হয়Ñ শূন্য হাতে এসেছি আবার শূন্য হাতেই ফিরব। এই পৃথিবীর কোনো কিছুরই স্থায়ী মালিক আমি নই। যুগ যুগ ধরে যেমন এই পৃথিবীতে সব কিছু স্থানান্তরিত হচ্ছে, মানুষের জীবনের বিবতর্ন হচ্ছে তখন আমি নিজেকে খুঁজে নিলাম বিধাতার রহস্যকে দেখার মাঝে নিজেকে হারিয়ে। আর তাইতো সীমানার বাইরে যে আকাশ আছে আমি সেখানে উড়তে চাই। আমি এই পৃথিবীতে এসেছি সৃষ্টির অপরিসীম রহস্যকে অনুধাবন করার জন্য। আর যখনি প্রকৃতির মাঝে আমি নিজেকে একাকার করে দিতে পারব তখনি আমি এই পৃথিবীকে এক্সপেরিয়েন্স করা শুরু করব। তখনি আমি সৃষ্টির গ্রেটনেসের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারব। আর এই সৃষ্টির রহস্যের মাঝে আমি যা কিছু দেখবো, শিখবো তা আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে শেয়ার করব। তরুণদের মাঝে যে শক্তি সম্ভাবনা আছে তাদের সেই শক্তির সঙ্গে আমি নিজেকে সামিল করতে চাই। দুঃখ-কষ্ট আমাদের থাকবেই, তার মাঝেও আমাদের নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে হবে।’

বাংলাদেশের নারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘নারীরা যে অনেক শক্তিশালী, তারা চাইলে যে স্বপ্ন জয়ের শিখরে পৌঁছতে পারে সেটা তাদের বিশ্বাস করতে হবে। নিজেদের চিন্তায় স্বাধীনতা ধারণ করতে হবে। তেমনি ভাবে পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের সবাইকে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে সহযোগী হতে হবে। জীবন যেন কোনো গÐীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়। চেষ্টা করলে এই জীবন অনেক সুন্দর হতে পারে। সে জন্য নারীদের শিক্ষিত হতে হবে, আত্মনিভর্রশীল হতে হবে। নারীদের জন্য শিক্ষা আর আত্মনিভর্রশীলতার বিকল্প আর কিছু নেই।

পজিটিভ মানসিকতা নিয়ে সবাইকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে নিজের উদ্যমতাকে কাজে লাগাতে হবে। কে নারী কে পুরুষ সেই চিন্তা পেছনে রেখে ‘আমরা সবাই মানুষ’ আমাদের একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আজ বহিবিের্শ্বর সব নারী নিজ নিজ যোগ্যতায়, সাহসিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও অনেক এগিয়েছি, আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। নারীরা আজ মহাকাশযাত্রা থেকে শুরু করে ছুটছে পৃথিবীর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আমাদেরও সব বাধা বিঘœ অতিক্রম করে সবকিছুকে জয় করতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা অনেক এগোচ্ছে। যারা পিছে পড়ে আছে তাদের বসে থাকলে চলবে না। নিজেকে শিক্ষিত ও পরিশ্রমী করে তুলতে হবে নিজেকেই!’

পরবতীর্ যাত্রার পদক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন নাজমুন, আমার স্বপ্ন জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ১৯৩ দেশ ঘুরে দেখা। আফ্রিকার বাকি দেশে ভ্রমণ ও বাই রোডে সেন্ট্রাল এশিয়ার সিল্ক রোড, পামির মালভ‚মি, কারাকোরাম পবর্তমালা পাড়ি দিয়ে তিব্বতের দিকে যাত্রার প্রস্তুতি। এ ছাড়া ভ্রমণের বই লেখার কাজ দ্রæত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। জগতের সব অজানাকে জানার জন্য ছুটছি, কিভাবে বিশ্বালয়ে সব পাথরভাঙা পবর্তশৃঙ্গ পাড়ি দিচ্ছি, একা চলেছি। ভয়কে জয় করে চলছি।

নাজমুন বলেন, আফ্রিকার ভাস্কো দা গামা রুট ‘কেপ টু কায়রো’ অথার্ৎ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে মিশরের কায়রো পযর্ন্ত আফ্রিকার বাকি দেশগুলো ভ্রমণ করবেন। কেপ টাউন থেকে তিনি নামিবিয়া হয়ে হয়ে যাত্রা করবেন।

বতর্মান সময়ে নারীপুরুষ সবক্ষেত্রেই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী পিছিয়ে নেই আর। কমের্ক্ষত্রে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে পা চালিয়ে নারী হয়েছেন প্রশংসনীয়। রাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, খেলাধুলা সবর্ত্রই তারা নিজেদের প্রমাণ করে চলেছে।

ঘর সামলানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, বিশ্বের নেতৃত্বেও পিছিয়ে নেই নারীরা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও তাদের প্রতিভা দিয়ে আন্তজাির্তক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করুক। আর

এইভাবেই লাল সবুজ পতাকা হাতে দেশ এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশকে নানাভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে, এগিয়ে দিতে আরও অসংখ্য নাজমুন তৈরি হোক, সেটাই প্রত্যাশা।

নারীদের জয় হোক সবর্ত্র।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19827 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1