শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
  ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বাত্মক শামিল হয়েছিল সমভাবে। ২৫ মার্চের কালো রাতের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এই বাস্তবতায় খানসেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে বিপন্ন নারী-শিশুর দল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চষে বেড়িয়েছে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বাছ-বিচারহীন। নারীরা ধর্ষণের শিকার বা অত্যাচারিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন বড় হয়ে উঠেছে, তার চেয়েও বড় সত্য হলো, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীসমাজ লড়াই করেছেন, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, রক্ষা করেছেন। অথচ যুদ্ধ-পরবর্তী প্রায় দুই দশকজুড়ে এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় তেমন করে আলোচিত হয়নি। ফলে একজন বীথিকা বিশ্বাস বা শিশির কণা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিলেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তারা যথাযোগ্য বীরের মহিমায় অভিসিক্ত হননি। উপরন্তু তাদের ললাটে জোটে সামাজিক লাঞ্ছনা। যুদ্ধ শেষে এই বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণাকে তাদের পরিবার ও সমাজ গ্রহণ করেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে এমন নারীর উদাহরণ অসংখ্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন 'একাত্তরের জননী' গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃতু্যবরণ করেছেন। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার অনেক নারীর মতো এ নারীর জীবনেরও ট্র্যাজেডি হলো, যুদ্ধের পর স্বামীগৃহে তার ঠাঁই মেলেনি। যুদ্ধকালে যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল; স্বামীহারা বিধবাদের দরকার ছিল আশ্রয়। এসবই তখন বড় করে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ৭১-এর নারী নির্যাতনকে বীরত্বের মহিমা দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে রাষ্ট্র। ফলে নির্যাতিত নারীদের 'বীরাঙ্গনা' আখ্যা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের নারীসমাজকে অবলোকন করা দরকার আন্তরিক বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে। প্রথমত বুঝতে হবে- যুদ্ধের সময় দেশের সর্বত্র যে বিপুল নারী নিগৃহীত হয়েছেন, তা কেবল তারা নারী বলেই। নারীদের এ-ও এক ধরনের যুদ্ধ, তার শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। সেটা বুঝতে সময় লেগেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার মতোই নারী আত্মোৎসর্গ করেছেন। সেটা বুঝতেও সময় লেগেছে অনেকের।

৬৯-এর গণআন্দোলন ও অভু্যত্থানে নারী ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। এই নারীরাই আবার স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে ধাপে ধাপে। যেখানে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বিদ্যমান। ৬৯-এর ১৯ জানুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর লাঠিপেটা করে সামরিক জান্তার সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। সেই সময় ছাত্রীরা সব মিছিল-আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারীসমাজ রাজবন্দি মুক্তি আন্দোলনে, গণআন্দোলনে, মিছিলে প্রতিদিনই যোগ দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের ৭ ফেব্রম্নয়ারি এই মহীয়সীর নেতৃত্বে সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আড়াই হাজার নারী সমাবেশ করেন, মিছিল করে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যান। ২৪ মার্চ ১৯৬৯-এ প্রকাশিত দৈনিক আজাদের তথ্যানুযায়ী বোরকা পরা হাজার হাজার নারীও যোগ দেন সেই মিছিলে। একাত্তরের উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে তখনকার রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার করলেন বাঙালি জাতিকে, তখন 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা'র কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন নারীরা। ফলে দেখা যাবে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, ঈশ্বরদী, পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় জেলায় নারীসমাজের প্রতিবাদী সভা ও মিছিল হয়েছে। এ সময় তারা জেলায়, শহরে-শহরে, এলাকায়-এলাকায় সংগঠিত হয়ে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও শুরু করেন। ৯ মার্চ বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। এই কাজে নারীসমাজ ও ছাত্রীসমাজ প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। (একাত্তরের গেরিলা : ২০)।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বহুমাত্রিকভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারীরা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও।

যুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বে নারী সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া, ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারপরও এ ক্ষেত্রে নারীরা ছিলেন অনড়। তারা সম্মুখসমরে অংশ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। কলকাতায় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধির পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩০০ তরুণীকে গোবরা ও 'বিএলএফ' ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। নারীদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সে সময় যুদ্ধকালীন সরকারের ভেতরই দ্বিধা ছিল।

অন্যদিকে বিভিন্ন যুবশিবিরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্রসংকটে অপেক্ষায় ছিলেন বিপুলসংখ্যক তরুণ। ছেলেরা যেখানে অস্ত্র পাচ্ছে না, যুদ্ধে যেতে পারছে না, প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না, সেখানে মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়ার গুরুত্ব বাংলাদেশ সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় ছিল না। তারপরও আলমতাজ বেগম গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম।

মুক্তিযুদ্ধে মায়েদেরও বড় অবদান রয়েছে। শহিদ রুমির মা জাহানারা ইমাম বা শহিদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মায়েরাই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তাদের এই ত্যাগও ইতিহাসের অংশ। মূলত এভাবেই নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অদম্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রম্নদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা- রক্তঝরা একাত্তরে নারীদের এসব সক্রিয় কর্মকান্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তখনকার সভানেত্রী সুফিয়া কামাল পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারিতে যুদ্ধের নয় মাস ঢাকায় তার বাড়িতেই ছিলেন। সে অবস্থায়ও তিনি নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। এসব তিনি তার সে সময়কার দিনলিপিতে লিখেছিলেন। যা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান; ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর (ভবানিপুর মাদরাসা), গোপালগঞ্জ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80723 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1