শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারী উদ্যোক্তার সফলতার গল্প

অসচ্ছল সংসার হলেও হাল ছাড়েননি অনুজা সাহা। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা আর মেধাকে পুঁজি করে পা বাড়িয়েছেন অনুজা। এই এগিয়ে চলাই আজ তাকে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা অদম্য একজন নারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে এই সমাজে। অনুজা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়ে আরও ২০০ নারীকে কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন।
আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনুজা সাহা। ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি তার জন্ম। পাবনা শহরের পৌর এলাকার গোপালপুর মহলস্নার অমূল্য কুমার সাহা ও অঞ্জনা সাহার একমাত্র কন্যাসন্তান। জন্মের ৩ বছর বয়সে নৃত্য আর সংগীত দিয়ে যাত্রা শুরু অনুজার।

শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সেলিম নাজির উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ৭৭ বছরের বৃদ্ধ শ্রদ্ধাভাজন অমূল্য কুমার সাহা আর গৃহিণী অঞ্জনা সাহার ইচ্ছা ছিল তাদের একমাত্র সন্তান অনুজা বড় হয়ে মানুষের সেবা করবে। সেই অদম্য ইচ্ছাকে সামনে রেখেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে মেয়েকে ভর্তি করেন উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠখ্যাত সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে এমএসসিতে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন অনুজা।

মানুষ গড়ার কারিগর অনুজার বাবা অমূল্য সাহা আক্ষেপ করে বলেন, স্বপ্ন ছিল মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে উপার্জনশীল করা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপর্যায়ে তার অনেক ছাত্র চাকরি করছেন। মেয়েটির একটি ভালো চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা-তদবিরও করেছেন। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি, মেয়ের জন্য একটি চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়সে এসেও মানুষ গড়ার এই কারিগর প্রাইভেট পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

অসচ্ছল সংসার, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও হাল ছাড়েননি অনুজা সাহা। চাকরির আশা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা আর মেধাকে পুঁজি করে পা বাড়িয়েছেন অনুজা। সাফল্য একদিন আসবে এমন আশায় বুক বেঁধে নেমে পড়েন কর্মের সন্ধানে। এই এগিয়ে চলাই আজ তাকে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা অদম্য একজন নারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে এই সমাজে। অনুজা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়ে আরও ২০০ নারীকে কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন।

অনুজা জানালেন, স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট যেন তাদের নিত্যদিনের সাথী হয়ে পড়েছিল। সংসার জীবনে তারা হয়ে পড়েছিল দিশাহারা। দেশীয় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই নারী চাকরির আশায় ঘুরতে থাকেন নানা অফিসে। কিন্তু জীবনচক্রে জোটেনি কোনো কর্মসংস্থান।

অনুজা বলেন, অবশেষে পত্রপত্রিকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের নারী উদ্যোক্তার গল্প পড়া শুরু করি। সেই থেকে চাকরির আশা ছেড়ে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা নিই। অবশ্য মা ব্যবসায় নামা পছন্দ করেননি। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে সংসারজীবনের নির্মম পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই অনুজাকে তার মা ব্যবসা করার অনুমতি দেন। অনুজার মাও একজন সুদক্ষ রাঁধুনি।

তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, শুরুটা হবে খাবারের ব্যবসার মাধ্যমে। স্বল্প পুঁজি নিয়ে আর মায়ের সহযোগিতায় অনুজা ক্ষুদ্র পরিসরে হোম ডেলিভারি খাবার সার্ভিস চালু করেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন অর্ণব অ্যান্ড কোং। হোম ডেলিভারি সার্ভিস থেকে নানা ধরনের পিঠা, কেক, মিষ্টি, বেকারি আইটেম, সাদা ভাত, বিরিয়ানি সরবরাহ শুরু হয় পাবনার নানা স্থানে।

অনুজা বলেন, সাফল্য একদিনে আসে না। সাফল্যর জন্য প্রয়োজন সময়, মেধা আর ধৈর্যের। বিভিন্ন স্থানের বড় বড় অর্ডার পেতে শুরু করেন অর্ণব অ্যান্ড কোং। ধীরে ধীরে এ ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। পুঁজির পরিমাণও বেড়ে যায়। এখানেই অনুজা থেমে নেই। বিসিক থেকে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ নেন। মায়ের কাছ থেকে সেলাই ও কাটিংয়ের কাজ শেখেন তিনি। সেটা কাজে লাগাতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ নেন যুব উন্নয়নের। পাশাপাশি শুরু করেন বুটিক হাউস ব্যবসা। সেটাও আলোর মুখ দেখতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই নৃত্য ও সংগীতচর্চায় পারদর্শী অনুজা গড়ে তোলেন 'মন ময়ূরী' নামের আরেকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এখানে আর্ট, নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি, হাতের লেখা শেখানো হয় কোমলমতি শিশুদের।

আলাপচারিতায় অনুজা জানান, হোম ডেলিভারি খাবারের প্রতিষ্ঠানে ২৫ জন ও বুটিক হাউসে ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করছে প্রতিদিন। তিনি বলেন, নিজেই আজ স্বাবলম্বী নন, ২০০ দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। এতে তিনি আনন্দিত।

অনুজার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী শ্রমিক আলপনা, পূর্ণিমা, অমলা, কৃষ্ণা, পারভিন, রেখা, লায়লা, রেহেনা, জলি, সিঁথি, তৃপ্তি, স্মৃতি ও রূপাসহ আরও বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, অভাব আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছিল। অভাব আর অনটন যেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। অনুজা আপার এই প্রতিষ্ঠানে সংসারের কাজের পাশাপাশি আমরা কাজ করছি। এখান থেকে যে পারিশ্রমিক পাই, তাতে আমরা মোটামুটি সচ্ছল হয়েছি। আমাদের কমে গেছে দরিদ্রতা। কাজ করছি। টাকা পাচ্ছি। নিজেদের ও সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতে স্বামীর মুখের দিকে তাকাতে হয় না।

অনুজা বললেন, সামাজিক ব্যবস্থায় নারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে নারীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন না। ইচ্ছে আছে নারীদের কল্যাণে, সহায়তায় ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করার। নিজের স্বল্প পুঁজি খাটিয়ে আজ ২০০ নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পেরেছি। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে হয়তো নারীদের উন্নয়নে আরেকটু এগোতে পারব। সমাজের পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, নির্যাতিত নারীদের নিয়ে সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই। তাদের স্বাবলম্বী করতে চাই। আর এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই পথচলা অব্যাহত থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90440 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1