শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
‘স্বপ্ন ছুঁয়েছে পাঙ্গাস চাষে- গ্রামের সবাই স্বাবলম্বী’

আটিয়ার পাঙ্গাস স্বাদে অতুলনীয়

জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৬

বাড়ি-বাড়ি পুকুর। পুকুর ভরা পাঙ্গাস মাছ। ঘরে-ঘরে পাঙ্গাস চাষী। পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের প্রায় সবাই এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। পুকুরের মাটি ও পানির গুনগত মান এবং পুষ্টিকর খাবারে উৎপাদিত পাঙ্গাস প্রচলিত জাতের হলেও স্বাদে অতুলনীয়। ফলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ সাফল্য জমিদারী আমলের আটিয়া পরগনার ‘আটিয়া’- বর্তমানে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া গ্রামের। আটিয়া গ্রামেই অবস্থিত সুফী সাধক শাহান শাহ আদম কাশ্মিরীর মাজার শরীফ। মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো মসজিদটি এখন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে দেশীয় মুদ্রা সংস্করণে দশ টাকার নোটের প্রচ্ছদে স্থান পাওয়ায় আটিয়ার পরিচিতি দেশব্যাপী। বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকদের আনাগোনাও রয়েছে।

আটিয়া গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এ গ্রামের প্রায় সবাই এখন পাঙ্গাস চাষে স্বপ্ন পুরণে ব্যস্ত। স্থানীয় নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণ করছে আটিয়ার পাঙ্গাস। মসজিদটির কারণে বিখ্যাত হওয়া আটিয়া গ্রামের জীবন-যাত্রায় এবার যোগ হয়েছে পাঙ্গাস চাষ। পাঙ্গাসের গ্রাম নামে নতুন পরিচয় পাচ্ছে ‘আটিয়া’। সুস্বাদু পাঙ্গাসের কারণে আটিয়া গ্রামের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।

সরেজমিনে জানাগেছে, ১৯৯৪ সালে ওই গ্রামের আসাদুজ্জামান আসাদ নামে এক ব্যক্তি প্রথম আটিয়াতে পাঙ্গাস মাছ চাষ শুরু করেন। আসাদুজ্জামান আসাদের কঠোর পরিশ্রম ও পুকুরের পানির গুণে পাঙ্গাসের ভালো ফলনে তিনি লাভবান হন। আসাদের সফলতায় উৎসাহিত হয়ে আটিয়ার যুবকরা পাঙ্গাস চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখন আটিয়ার ঘরে-ঘরে পাঙ্গাস চাষী। এই গ্রামে দেড় শতাধিক পুকুরে এখন পাঙ্গাস চাষ হচ্ছে। পোনা মজুদ, পাঙ্গাস চাষ, মাছ ধরা, এমনকি বাজারে বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রায় সবাই এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাঙ্গাস চাষের সাথে যুক্ত। প্রায় দুই যুগের পাঙ্গাস চাষের ইতিহাসে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তবে গত কয়েক বছরে ধাপে-ধাপে খাবারের দাম বেড়ে দ্বিগুন হওয়ায় পাঙ্গাস চাষের আগামি দিনগুলো নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ন্বপ্নের পাঙ্গাস চাষকে সহজতর করতে খাবারের দাম কমানো, মাছ সরবরহের ব্যবস্থাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছে পাঙ্গাসের গ্রাম আটিয়ার চাষীরা।

প্রতিষ্ঠিত পাঙ্গাস চাষী আসাদুজ্জামান আসাদের এখন চারটি পুকুর। দুইটিতে ৩০ হাজার পাঙ্গাস চাষ করেন। বাকি দুইটি পুকুরে পাঙ্গাসের পোনা মজুদ রাখেন। তিনি জানান, নব্বইয়ের দশকে আটিয়ায় তিনিই প্রথম পাঙ্গাস চাষ শুরু করেন। গ্রামে এখন দেড় শতাধিক পুকুরে পাঙ্গাস চাষ হচ্ছে। তিনি অভিযোগের সুরে জানান, বর্তমানে পাঙ্গাসের খাবারের দাম দ্বিগুন। ৭-৮ শ’ টাকা মূল্যের খাবারের বস্তা হয়েছে ১৭-১৮শ’ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সে তুলনায় মাছের দাম বাড়েনি, আগের দামেই পাঙ্গাস বিক্রি করতে হচ্ছে। পাঙ্গাস চাষে জেলা-উপজেলায় দুইবার সেরা চাষীর পুরস্কার পেলেও বর্তমানে পাঙ্গাস চাষ নিয়ে হতাশায় রয়েছেন তিনি।

আসাদের পর ১৯৯৯ সালে পাঙ্গাস চাষ শুরু করেন বায়েজিদ হোসেন জুয়েল। তার চারটি পুকুরে ১৫ থেকে ২০ হাজার পাঙ্গাস চাষ করেছেন তিনি। জুয়েলও পাঙ্গাস চাষে খাবারের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ৩২-৩৪ টাকা কেজির খাবার দাম বেড়ে ৫২-৫৩ টাকা কেজি। প্রতি কেজিতে ২০-২২টাকা মূল্য বেড়েছে।

আটিয়ার ডা. লুৎফর রহমান ও জায়েদুর রহমানরা সাত ভাই মিলে ৬টি পুকুরে পাঙ্গাস চাষ করেছেন। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডা. লুৎফর রহমান বিকল্প পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। খাবারের সব ধরনের কাঁচামাল কিনে কারখানা থেকে ভাঙিয়ে এনে পুকুরে দেন। ফলে মাছের খাবারের উর্ধ্বগতিতেও লাভের হিসাব আগের মতোই গুনছেন তিনি। স্থানীয় কেউ কেউ ডা. লুৎফর রহমানকে অনুসরণ করছেন আবার কেউ কেউ বাড়িতে খাবার তৈরি করতে ছোট আকারের মেশিন কিনে বাড়িতে বসিয়ে খাবার তৈরি করছেন। এতে তাদের পাঙ্গাসের খাবারের খরচ আরও কমে এসেছে।

স্থানীয় খায়রুল হোসেন বাচ্চুও চারটি পুকুরে পাঙ্গাস চাষ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে পাঙ্গাস চাষ করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনলেও বর্তমানে খাবারে দাম বেড়ে যাওয়ায় হোঁচট খাচ্ছেন তিনিও। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা নারী ঝরনাও শুরু করেন পাঙ্গাস চাষ। বেঁচে থাকা অবস্থায় স্বামীর কাছ খেকে শিখেছিলেন কিভাবে পাঙ্গাস চাষ করতে হয়। মাছ চাষ করেই দুই মেয়ের বিয়ের খরচ যুগিয়েছেন তিনি। বাকি দুজনের ভরণ-পোষণের জন্য মাছ চাষ ছাড়েননি তিনি। ঝরনার মতো গ্রামের অনেকেই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকছেন। ফলে আটিয়া গ্রামে বেকারত্ব নেই বলেই চলে। সবাই এখন স্বাবলম্বী।

আটিয়া গ্রামের চাষীরা প্রতি হাজার পাঙ্গাস চাষ করে বছরে ২৫-৩০ হাজার টাকা উপার্জন করছে। একজন চাষী ২৫ থেকে ৩৫ হাজার পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অর্থনীতির চাকা বদলে দিয়েছে। একদিকে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছেন, অন্যদিকে গ্রামের অর্থনীতিকে মজবুত করেছেন। মাছের বর্তমান পাইকারী বিক্রি মূল্য মন প্রতি চার থেকে চার হাজার ২০০টাকা। পাঙ্গাস চাষে খাবারের দাম দফায়-দফায় বেড়ে দ্বিগুন হলেও মাছের পাইকারী দাম কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১০৫ টাকার মধ্যেই রয়েছে। সম্প্রতি পাঙ্গাস চাষীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। খাবারের দাম না কমলে পাঙ্গাস চাষ থেকে অনেক চাষী ছিটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল ইসলাম মল্লিক জানান, আটিয়া একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এ গ্রামের মানুষ মূলত কৃষি কাজের উপরই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে পাঙ্গাস চাষে সাফল্য পাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই পাঙ্গাস চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। তিনি আরও জানান, জেলার অন্যান্য এলাকায় চাষ করা পাঙ্গাসের তুলনায় আটিয়ার পাঙ্গাস স্বাদের ভিন্নতায় অতুলনীয়। তাই এ এলাকার পাঙ্গাসের চাহিদাও বেশি।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল হক জানান, দেলদুয়ারের আটিয়ার পাঙ্গাস প্রসিদ্ধ। পাঙ্গাস চাষ করে গ্রামের অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তারা সাধ্যমতো পাঙ্গাস চাষীদের সহযোগিতা করছেন। জেলা-উপজেলা মৎস্য অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে মাছ চাষীদের পাশে রয়েছেন।

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে