জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর উপকুলে বসবাসকারী কৃষকরা দীর্ঘদিন মানবেতর জীবন যাপন করার পর তারা লাভজনক শস্য চাষ আবিস্কার করেছেন। বর্তমানে তারা ভুট্টার বাম্পার ফলন ফলিয়ে হয়ে উঠছেন আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী।
এরেই পথ ধরে কুড়িগ্রাম জেলা সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রহিম নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে ২৫ বছর আগে হলোখানা ইউনিয়ন হতে স্থানান্তরিত হন। ৪ সন্তানের কারোরেই চাকরি না থাকায় নিদারুণ দুরাবস্থা ও অভাব অনটনের এক পর্যায়ে অতিকষ্টে চার লক্ষ টাকা ব্যয় করে ১ ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু দূর্ভাগ্য তাকে তাড়া করে,প্রতারকের চক্করে পড়ে নিঃস্ব হয়ে ছেলে ফিরে আসে বাড়িতে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বিদেশ ফেরত ছেলেকে নিয়ে তিনি শুরু করেন চরের অনুর্বর বালু মাঠিতেই ফসল উৎপাদন।
শুরুতে বিভিন্ন রকম ফসল উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হয় তাকে। কয়েকবছর থেকে তার স্বস্তি ফিরে এসেছে ভুট্টার চাষে। এবার ধরলার চরে ২০ একর জমিতে তিনি ভুট্টা চাষ করেছেন। উৎপাদন অনেক ভালো হওয়ায় সব মিলিয়ে ভালো লাভের আশা করছেন তিনি।
আব্দুর রহমান প্রতিবেদককে জানান,এক সময় অনেক অভাব অনটন ছিল তার পরিজন নিয়ে। পরনে জামা ছিল না। ছেলেদের নিয়ে কষ্টের শেষ ছিলো না। নদী ভাঙ্গনের সবকিছু যখন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তখন হলোখানা থেকে এসে ভোগডাঙ্গায় বসতি করি। শুরুতে বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করেছিলাম। কিন্তু তাতে যে পরিমাণ পরিশ্রম ও ব্যয় করেছি সে অনুযায়ী লাভের মুখ দেখিনি। কখনও ভালো ফসল মিললেও উপযুক্ত মূল্য পেতাম না। অবশেষে গেল পাঁচ বছর ধরে ভুট্টা চাষ করছি। এই ভুট্টা চাষ করে আমি সত্যিকার অর্থে সফল হয়েছি। এ বছরও ২০ একর জমিতে ভুট্টাচাষ করেছি। আশা করছি সবকিছুর খরচ বাদ দিয়ে আট লক্ষ টাকা লাভ হবে। সংসারে সুদিন ফিরেবে ভুট্টা চাষ করে ইনসো আল্লাহ ।
শুধু আব্দুর রহিম নয় বরং জেলার শিক্ষিত বেকার যুবকেরাও ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষের দিকে। পাঁচগাছি ইউনিয়নের এম এ পাস ৩ বেকার যুবক এবার ধরলার চরে ৬ একর জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। ধরলার চরে গিয়ে দেখা যায়, ভুট্টা উত্তোলন ও মারাইয়ের মহা উৎসব। ৬ একর জমিতে ৪ লক্ষ টাকা উৎপাদন খরচ হয়েছে তাদের। সবকিছু বাদ দিয়ে তারা লাভের আশা করছেন তিন লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
৩ বন্ধুর মধ্যে আতাউল করিম নামের নব কৃষি উদ্যোক্তা বলেন, এ বছর ধরলার বালু জমিতে আমরা তিন বন্ধু মিলে ভুট্টার চাষ করেছি। আশা করছি সব ঠিকঠাক থাকলে প্রতি একরে ভুট্টার ফলন হবে ৩০-৩৫ মন। সাধারণত এখানে যারা ভুট্টার আবাদ করে তারা একর প্রতি উৎপাদন করতে পারে ১৭-২০ মন। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করেছি, তাতে উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। আমরা চাই আমাদের দেখে যেন অন্যরা যেন উদ্বুদ্ধ হয়।
কুড়িগ্রাম জেলায় শুধু এই ধরলা নদীর চরেই নয় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধ কুমর, ফুল কুমর, গঙ্গাধরসহ ১৬ টি নদীর অববাহিকায় প্রতিবছর হয়ে আসছে এই ভুট্টার চাষ।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ হাজার ৮০ হেক্টর জমি। কিন্তু অর্জিত হয়েছে ১৮ হাজার ৭ শত ৫০ হেক্টর জমিতে।
প্রকৃতি অনুকূলে থাকায়,কুড়িগ্রামে চরের অনুর্বর বালু মাটিতেই হয়েছে এবার ভুট্টা ফলনের বিপ্লব। নদী বেষ্টিত এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য চরাঞ্চল। আর এসব চরাঞ্চলে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভুট্টার চাষ। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে লাভ ভালো হওয়ায় দিন- দিন সাধারণ কৃষকরাও ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষের দিকে।
সরেজমিনে ধরলা,দুধকুমার,ব্রহ্মপুত্র সহ বিভিন্ন নদ-নদীর চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়,প্রতিদিন ক্ষেত পরিচর্যা, উত্তোলন সহ নানাবিধ কাজে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের চলছে সেখানে অবিরাম কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন কাজের বিনিময়ে পুরুষ শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৫'শ ও নারী শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৪'শ টাকা মাথাপিছু হারে দিনমজুরী। ভুট্টার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় অনেকেই আবার ভুট্টার গাছ, পাতান এবং মোছা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের বিনিময়ে ভুট্টা ক্ষেতে শ্রম আত্মনিয়োগ করছেন।
শুধুমাত্র ভুট্টার মোছার বিনিময় কাজ করতে আসা মতিন মিয়া বলেন, ভুট্টার আবাদে যেমন কৃষকরা লাভবান হচ্ছে অন্যদিকে এর সাথে জড়িতরা কাজ করে অনেকেই দৈনন্দিন জীবন ধারণ করছেন। আমরা এখানে মোছার বিনিময়ে কাজ করছি।
মমেনা বেগম বলেন, আমরা এই ভুট্রার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। তাই গাছ কাটতেছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি কুড়িগ্রাম এর জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার ডা. মামুনুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকায় এ বছর কুড়িগ্রাম জেলায় ভুট্টার ফলন ভালো হয়েছে। ভুট্টা একটি লাভজনক ফসল। আমরা নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছি। তবে আমরা এখন কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি চরের যেসব অনুর্বর জমি আছে তাতে ভুট্টা চাষ করতে। তবে যে সব জমিতে ধানের ফলন ভালো হয় সে সব জমিতে ভুট্টা চাষ করতে আমরা সংশ্লিষ্ট কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি।