মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাক খাতে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় জানুয়ারিতে : বিজিএমইএ

তুরাগ (উত্তরা) প্রতিনিধি
  ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৭
ছবি-যায়যায়দিন

দেশের পোশাক খাতে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের মাস হিসেবে উঠে এসছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের নাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত ‘From Shirts to Shores: A Blueprint for Bangladesh RMG Industry’ শীর্ষক এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ সেমিনারে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান।

পরিসংখ্যানে বলা হয়, এপ্রিল ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ এই এক বছরে বাংলাদেশে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ছিল ৩৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৬.৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর এপ্রিল ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত এই খাতে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৮.৯৪ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ২০২৪ সালের শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই রপ্তানি হয়েছে ৪.৯৭ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক। যা বিগত বছরগুলোর যেকোন বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ রপ্তানির মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসময় লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সভাপতি চলতি ২০২৪ সাল নাগাদ পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা রপ্তানিখাতে ভালনারিবিলিটি কাটিয়ে উঠার জন্য বরাবরই বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার তৈরি উপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।

তিনি বলেন, বিগত ১৪ বছরে দেশের পোশাক রপ্তানি ৮৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে দশগুণ বেড়ে ৮.৩৭ বিলিয়ন ডলার এসে পৌঁছেছে এবং চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে নতুন বাজারগুলোতে আমাদের পোশাক রপ্তানি ১০.৮৩% বেড়েছে। বিশেষ করে তুরস্ক, সৌদি আরব, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে আগের তুলনায় রপ্তানী অতুলনীয় হারে বেড়েছে বলে জানান তিনি।

বিজিএমইএ এর ওই পরিসংখ্যান রিপোর্ট বলছে, করোনা মহামারীর পূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয় ছিল ৪০.৫৪ বিলিয়ন ডলার। যেখানে তৈরী পোশাক রপ্তানির পরিমান ছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ পোশাক রপ্তানির শেয়ার ছিল ৮৪.২১%। সে বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৪৯%, যা আগের বছরের তুলনায় ৩.৫২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় দেশের পোশাক রপ্তানি নেমে আসে ২৭৯৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি ২৭,৯৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩১.৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়; যা প্রায় ১২.৫৫% বেশি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১০.২৭% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৬.৯৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট রপ্তানিতে পোশাকের শেয়ার পৌঁছেছে ৮৪.৫৮%।

সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এই শেয়ার ৮৫.৪২% এ পৌঁছে গেছে এবং এই সময়টিতে আমাদের অর্জিত প্রবৃদ্ধি ৫.৫৩%। আর ২০২৪ ক্যালেন্ডার বছরের জানুয়ারী-মার্চ সময়ে পোশাক রপ্তানি ছিল ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬.২৪% বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিজিএমইএ।

এদিকে, রপ্তানিতে দেশের পোশাক খাত আগের তুলনায় অধিক শক্তিশালী এবং বাংলাদেশ এখন শুধু শ্রম নির্ভর সস্তা পোশাকের দেশ নয় উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমরা উচ্চ মূল্যের পণ্য তৈরী ও উচ্চ মূলা সংযোজনের দিকটিতেও যথেষ্ট এগিয়ে গেছি এবং বর্তমান সময় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ হিসেবে তিনি জানান, ২০২৯ এর পর ইউরোপে জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রাপ্তির জন্য লোকাল ফেব্রিকের বিকল্প নেই। এই জায়গাটিতে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন; যেন আমরা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ যাতে ওভেন ও নন-কটন টেক্সটাইলে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে পারি।

সভায় বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, এই শিল্পকে টেকসই এবং ব্যবসায় গতি আনার জন্য ভারত থেকে সুতা আমদানির জন্য বেনাপোলের পাশাপাশি আরও ৪টি স্থলবন্দরের অনুমোদন এবং পার্শিয়াল শিপমেন্ট অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানীকৃত তুলার উপর ডাবল ফিউমিগেশন এর নিয়ম বাদ, বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স ও রেজিষ্ট্রেশনের মেয়াদ ৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্ড লাইসেন্সের আওতা ও মেয়াদ বৃদ্ধি, ঋঙঈ এর আওতা বৃদ্ধি, কর্পোরেট ট্যাক্স ৬ বছরের জন্য স্থিরকরণ, টেকনোলজি আপগ্রেডেশন এর জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, গ্রীন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড নামে স্বল্প সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে ৫০০০ কোটি টাকার তহবিল, 'লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি'র মতো সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

তবে, এসব উদ্যোগ গ্রহণের পরেও পরেও মাঠ পর্যায়ে কাস্টমস ও বন্ড সংক্রান্ত হয়রানি রয়ে গেছে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমাদের কারখানাগুলো এখনও এসব সেবা প্রাপ্তিতে নানা ইস্যুতে ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে তা আমাদের ব্যবসা ও অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে আরও গতিশীল করবে।

অপরদিকে বিজিএমইএ এর পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের এই শিল্পের নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি দুটিই বেড়েছে প্রশংসনীয় হারে। ২০২০-২২ অর্থ বছরের রপ্তানি অনুযায়ী দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৪% ছিলো কটনের তৈরি হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭০% এ নেমে আসে। এতে সমসাময়িক বছরগুলোতে বাড়ে নন-কটন খাতের বিনিয়োগ ও রপ্তানি। এর বাইরে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক- মসলিন, জামদানী, সিল্ক খাদী ব্যবহার করে রপ্তানি পন্য তৈরির বিষয়ে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে বলে সভায় জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হোসেন।

এ বিষয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় দেশীয় প্রদর্শন করেছি। এসব পন্য ও কাঁচামালের যোগান আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে যা ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বারা উন্মোচন হতে পারে। এছাড়াও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে ৩ দিন ব্যাপী 'বাংলাদেশ হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল' আয়োজনের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।

বিজিএমইএ’র প্রতিবেদন বলছে, দেশে স্থানীয় পর্যায়ে শিল্পের মূল্য সংযোজন সংক্ষমতা বাড়ায় পণ্য রপ্তানিতে এখন পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ অফার দিতে পারছে প্রস্তুতকারকরা। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে বলে জানিয়েছে তৈরি পোশাকখাতের ব্যবসায়ীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বিজিএমইএ।

এ বিষয়ে আশার কথা উল্লেখ করে সংগঠনটি বলছে, স্থানীয় পর্যায়ে দেশের শিল্পের মূল্য সংযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একদিকে ফ্লেক্সিবিলিটি বৃদ্ধি অপরদিকে ক্রেতাদেরকে ফুল প্যাকেজ অফার করা যাচ্ছে। এতে বৈদাশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দেশের রিজার্ভের উপর চাপও প্রশমিত হয়েছে বলে জানায় বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগষ্ট মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে ২৫.২৪ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে। গত বছর নভেম্বরে ১৯.৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। যদিও ২০২১ থেকে এ পর্যন্ত আমাদের রপ্তানি কমেনি, তারপরেও রিজার্ভের উপর চাপ রয়েই গেছে মূল্য সংযোজন না বাড়লে এই চাপটি আরও বাড়তো।

ভবিষ্যতে পোশাক খাতে রপ্তানী বৃদ্ধি করতে কৌশলগত ভার্চুয়াল মার্কেটে সক্ষমতা বাড়াতে সরাসরি বিজনেস টু বিজনেস, বিজনেস টু ভোক্তা পর্যায়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে তৈরি হওয়া স্যুট, লঞ্জারী ও ওয়ার্ক-ওয়্যার এর মত পন্যে রপ্তানি বাড়ছে। যদিও এসব পণ্যের কাঁচামাল ও টেকনোলজির দিকগুলোতে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও এসব উচ্চ মূল্যের পোশাক প্রমোশনের জন্য পর্যাপ্ত মেলা আয়োজন এবং মেলায় অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য প্রতিবেদনে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহযাগিতা চাওয়া হয়েছে।

এসময় সভায় পোশাকখাতে সবুজ শিল্পায়ন গড়ে তোলায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, রিসাইক্লিং শিল্পে বিনিয়োগ সম্ভাবনা, প্রযুক্তির ব্যবহার, শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য লিড টাইম হ্রাস করা, সর্বশেষ প্রযুক্তি গ্রহন করা, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা এবং কারখানাগুলোকে টেকসই করার মতো ইত্যাদি বিষয় বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হয়।

পরিশেষে, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় ভবিষ্যতে এই পোশাক রপ্তানিখাতে বাংলাদেশ কিভাবে এগিয়ে থাকতে পারে সে বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপার্স প্রাইভেট লি. এর সিইও অরিন্দিম সাহা ও তার দল। বিজিএমইএ এর পক্ষ থেকে বলা হয়, এই গবেষণা প্রতিবেদন ভবিষ্যত বাংলাদেশের পোশাকখাতের কৌশলগত ভিত্তি অটোমেশন, ডিজিটাইলেজন এবং দক্ষ সম্পদ উন্নয়নে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন ও নতুন দক্ষতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ দিক, অর্থায়নের উৎস ইত্যাদি ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা প্রদান করবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে