শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

​সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত শিক্ষা জীবন!

ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৪৬

ঢাকার সরকারি ৭ কলেজ, ফলাফল বিপর্যয় থেকে বাঁচতে ও শিক্ষারমান উন্নয়নের লক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। অধিভুক্ত হওয়ার চার বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে কিন্তু এখনও হয়নি শিক্ষারমান উন্নয়ন, কাটিয়ে উঠতে পারেনি ফলাফল বিপর্যয়। সেশনজট, ফলাফল বিপর্যয়সহ ভয়াবহ সব দুর্ভোগ এখন সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিটি পরিক্ষায় ফলাফল বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছে শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ প্রকাশিত হওয়া স্নাতক ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ সেশনের ফলাফলেও দেখা যায় একই চিত্র। বিপর্যয়ের সম্মুখিন হওয়া শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়, নিজ ক্যাম্পাসে ঘুরেও পাচ্ছে না কোন কার্যত সমাধান। ব্যর্থ হয়ে বার বার আন্দোলনে নামতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। গণহারে ফেল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, ১খাতা না দেখে মার্ক দেওয়া কিংবা খাতা হারিয়ে ফেলা। অথবা নতুন মানবন্টনে টিচারদের অভ্যাস না থাকায় ভুল মার্কিং এবং পরিক্ষার সিলেবাস না কমিয়ে ৪ ঘণ্টার জায়গায় ২ ঘণ্টায় পরিক্ষা নেওয়াসহ আরো কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন তাঁরা।’

স্নাতক শেষ বর্ষ ২০১৫-১৬ সনের প্রকাশিত হওয়া ইংরেজি বিভাগ'র ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ইডেন মহিলা কলেজে ২১০ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ১৭৫জন, তিতুমীর কলেজ থেকে ২৪১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯৩ শিক্ষার্থী এবং সরকারি বাঙলা কলেজে ১১৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯২ শিক্ষার্থীকে ফেল দেখানো হয়। একইভাবে অন্য চার কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ফেল দেখানো হয়। ইংরেজি বিভাগ ছাড়াও হিসাববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রাষ্টবিজ্ঞানসহ প্রায় প্রতিটি বিভাগের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ঠি প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা কলেজর ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের বিভিন্ন বর্ষের পরিক্ষা সিলেবাস না কমিয়ে ৪ ঘণ্টার জায়গায় ২ ঘণ্টায় নেওয়া হয়। এছাড়াও করোনার কারণে ক্লাস না হওয়ায় সিলেবাস শেষ করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে রুটিন আর একটার পর একটা পরীক্ষা চলমান থাকা। যেটা রেজাল্ট কে প্রভাবিত করেছে। শিক্ষকদের উচিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে খাতার মূল্যয়ন করা।

ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ফলাফল বিপর্যয়ে সাত কলেজের শিক্ষকদের দায়ি করে বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয়ে আমাদের সাত কলেজের শিক্ষকরাই দায়ী। আমাদের খাতায় আমাদের শিক্ষকরা পরিপূর্ণ মার্ক দেননা।’

এছাড়াও বিলম্বে ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পিছনেও সাত কলেজ শিক্ষকদের গাফিলতিকে দায়ি করছেন এই শিক্ষার্থী। তারা সঠিক সময়ে খাতা ঢাবিতে প্রেরণ করেন না। যার প্রমাণ আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার বক্তব্য এবং সর্বশেষ সাত কলেজের ১৪ জন শিক্ষককে শোকজে প্রমাণ পেয়েছি।’ ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থীর দাবি, ফলাফল বিপর্যয় না হলে আমাদের সেশনজটও ধীরে ধীরে কমে আসবে।

তিতুমীর কলেজ মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী নোমান উদ্দিন বলেন, ’তিতুমীর কলেজ মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক চর্তুথ বর্ষের পরীক্ষায় ১৭০জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ১২০ শিক্ষার্থেই 'বাংলাদেশ ইকোনমিক' বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। তিনি দাবি করেন, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না যে, ১৭০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২০ জন অকৃতকার্য হয়।’

ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ফারহা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বিভাগে এক শিক্ষার্থী গত তিন বর্ষে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে উত্তির্ন হলেও শেষ বর্ষে এসে এক বিষয়ে ফেল দেখানো হয় তাকে৷ কিন্তু অন্য সকল বিষয়ে সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এমন শিক্ষার্থী যে কিনা প্রতিটি বিষয়ে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে উত্তির্ন হচ্ছে, সে একটা বিষয়ে পাশ করার যোগ্যতা রাখে না? তাহলে এমনটা কেন হচ্ছে?’ এর একটাই কারণ, শিক্ষকদের গাফিলতি। ফারহা আরও বলেন, চার ঘণ্টার পরীক্ষা দুই ঘণ্টায় নেওয়া হলেও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ করার সময় সেভাবে মূল্যায়ণ করেননি শিক্ষকরা। যার ফলে এমন বিপর্যয় হতে পারে বলে জানান তিনি।

সরকারি তিতুমীর কলেজ গনিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাকে এমন একটি বিষয়ে ফেল দেখানো হয়ছে, যেখানে এ+ পাওয়ার সম্ভাবনা রাখি। নিঃসন্দেহে এখানে শিক্ষকদের পরিক্ষার খাতা মুল্যায়ণের ক্ষেত্রে গাফিলতি রয়েছে। তা না হলে আর যায় হোক ফেল করার কথা না! আমি ফেল করার মতো পরীক্ষা দেয়নি।’

এ বিষয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজ সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার জানান, যদি শিক্ষকদের গাফিলতি থেকে থাকে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।’ একটি দরখাস্ত দেখিয়ে বলেন, ‘এইযে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি। তারা যেন বিষয়টা পর্যালোচনা করেন। আমরা চেষ্টা করতেছি দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সকল সমস্যা সমাধান করার কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের কিছুটা ব্যগ পেতে হচ্ছে।’

এ সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘অধিভুক্ত হওয়ার শুরু থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে আসতেছি, তারা যেন ভালো করে পড়াশোনা করে। শুরুর দিকে খুব একটা ভালো ফলাফল না হলেও এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করছে। আশাকরি সামনে আরও ভালো করবে। এছাড়াও যেসকল বিষয়ে গণহারে ফেল দেখানো হচ্ছে, সেসব বিষয় নিয়ে আমরা একটা সমাধান করার চেষ্টা করছি।’

ঢাকা কলেজ ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক পুরঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলাকালীন, তৃতীয় বর্ষের মানোন্নয়ন পরীক্ষা শুরু হয়। যার ফলে কিছু শিক্ষার্থীকে তৃতীয় বর্ষের মানোন্নয়ন পরীক্ষার পরের দিনই ৪র্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হয়েছে।’ যার ফলে পরীক্ষা খারাপ হতে পারে বলে জানান তিনি। এছাড়া এটাও মেনে নিতে হবে যে, সকল শিক্ষক সমানভাবে খাতা মূল্যায়ণ করেন না। যার ফলে দেখা যাচ্ছে, "স্যার একটু কঠোরতার সাথে খাতা মূল্যায়ন করলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ফলাফল খারাপ হয়।’

তিনি আরও বলেন, ফলাফল বিপর্যয়ের প্রধান এবং অন্যতম কারণ, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যদিও করোনার মধ্যে দেশে সর্বপ্রথম অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা কলেজ। কিন্তু গ্রামে নেটওয়ার্ক ব্যাবস্থা ভালো না থাকায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাহিরে থেকে যায়।

তিতুমীর কলেজ মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান মনে করেন করোনর জন্য শিক্ষার্থীদের এমন ফলাফল বিপর্যয় ঘটতে পারে। মহামারীর কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামে চলে যায় এবং পরীক্ষার রুটিন প্রকাশিত হলে ঢাকায় ফিরে আসে। এই অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। যার ফলে এমনটা হতে পারে বলে জানান তিনি।

ইডেন মহিলা কলেজ ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জাহানারা বেগম শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় আরও অধিক মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা নতুন মানবন্টনের সাথে পরিচিত নই। তাদের অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ১০নাম্বার বাদ দেওয়া হয়েছে। বড় প্রশ্নের উত্তর করতে গিয়ে বানান ভুলসহ গ্রামারে ভুল থাকে, যার ফলে ফলাফল সন্তোষজনক হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার জন্য শিক্ষকদের দোষারোপ না করে, নিজেকে তৈরী করতে হবে৷ নিজেদের দূর্বলতা খুঁজে বের করে, তা সংশোধন করার চেষ্টা করতে হবে। তবে ভবিষ্যতে ভালো ফলাফল করার সম্ভবনা থাকবে।’ এবিষয়ে ঢাবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাহালুল হক চৌধুরীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

উল্লেখ্য,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ সালে রাজধানী ঢাকার সরকারি সাত কলেজ ঢাকা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজ শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় । সরকারি সাত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট সকলে।

যাযাদি/এসএইচ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে