বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতা ও দমন-পীড়নের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) সিন্ডিকেট তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্ত এই কমিটির দুই সদস্যই আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। ফলে তদন্ত শুরুর আগেই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা যায়, গত ২৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ তম সিন্ডিকেট সভায় এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হলেন― আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মু. আলী মুর্শেদ কাজেম, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান।
ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান ২০২২ সালের বঙ্গবন্ধু পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির শিক্ষা ও গবেষনা সম্পাদক হিসেবে ছিলেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির না থাকলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মানববন্ধনে তাকে দেখা যায়। বিগত সময়গুলোতে যেসকল শিক্ষক বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন তারা মু. আলী মুর্শেদ কাজেমকে একজন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবেই চিনেন বলে জানান। এছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী জামায়াত-বিএনপির ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে করা একটি মানববন্ধনেও তাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। যার ছবি এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু পরিষদের একজন অধ্যাপক বলেন, 'মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। মাহমুদুল হাসান খান স্যার ও কাজেম এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকার পরিবর্তন হতে না হতেই তারা তাদের নতুন রুপে ধরা দিয়েছেন। তারাও তো স্বৈরাচারের দোসর।'
এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান, 'আমি জুলাই আন্দোলনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলাম। এখন প্রশাসন কেন মনে করলো আমাকে দিতে এটি প্রশাসনের প্রশ্ন। আমি তো বলিনি আমাকে রাখতে।'
মু. আলী মুর্শেদ কাজেম বলেন, 'কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষক ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো। বিভিন্ন পরিষদ, সমিতির সাথে যুক্ত ছিলো। এটা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক। ধারণ করে হোক বা না করে হোক। তবে, আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে ছিলাম না।'
কুমিল্লা জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মুহাম্মদ সাকিব হুসাইন বলেন, 'আন্দোলন চলাকালীন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সম্মানিত শিক্ষক আমাদের এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আমাদের পাশে দাড়িয়ে ছিল। শুনতে পেরেছি বিগত আমলে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের শনাক্ত করতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এমন কিছু হওয়া মানে ফ্যাসিস্টদের সহচরদের নতুন করে সুযোগ করে দেওয়া।'
তিনি আরো বলেন, 'আমরা লক্ষ্য করেছি, পাঁচ আগস্টের পরবর্তী সময়ে এই ফ্যাসিস্টদের সাথে জড়িতদের সহযোগিতায় বড় বড় রাঘববোয়ালেরা দেশ ত্যাগ করেছেন। এখনো বিচারের বাহিরে আছেন। আমরা চাই ফ্যাসিস্টদের শনাক্ত করতে ফ্যাসিজম থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হোক। অন্যথায় ন্যায়সংগত কিছুই আশা করাই হবে আত্মঘাতী।'
জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য হাফসা জাহান বলেন, 'আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নিয়ে যদি কমিটিটি গঠন করা হয় তাহলে এটি ঠিক হয়নি। এখনো যদি ফ্যাসিস্টদের সুযোগ করে দেওয়া হয় তাহলে এটি কোনোভাবেই সঠিক হবে না।'
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, 'এখানে যেহেতু তারা (আওয়ামীপন্থী শিক্ষক) আছেন তাহলে তো তারা আরও সহজে জড়িতদের বের করতে পারবেন। আর আমরা আসলে স্বচ্ছতার জন্য একটি কমিটি করেছি। আইন, বিধি ঠিকঠাক ভাবে দেখতে আইন বিভাগের শিক্ষকও রেখেছি। পাশাপাশি, প্রশাসনও নজর রাখবে।'
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই বিগত সরকারের রাজনীতির সাথে জড়িত। এখন আমরা বিগত সরকারের রাজনীতি না করা লোকেদের কীভাবে খুঁজে পাবো? আরেকটি বিষয় কমিটিটি সিন্ডিকেটে সকলের মতামতের ভিত্তিতে হয়েছে। এখন এই কমিটিটি নিয়ে কোনো অবজেকশন থাকলে আমরা আগামী সিন্ডিকেটে আবারও কথা বলবো।'
বিগত সরকারের রাজনীতির সাথে জড়িতদের নিয়ে কমিটির প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা থাকবে কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'এখানে চরমভাবে স্বচ্ছতা হারাবে। আমরা চেষ্টা করবো আগামী সিন্ডিকেটে এটি নিয়ে কথা বলার।'