শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষক পর্যায়ে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি

আলতাব হোসেন
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

গ্রামের হাটবাজারে মাত্র দুই থেকে তিন টাকায় বিক্রি হচ্ছে ফুলকপি। ঘাম ঝরানো কষ্টের ফসল অনেকটা পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। কোনো কোনো এলাকায় এ দামেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এবার বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের সবজির দাম কমেছে। বিক্রেতা ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার খেত থেকে তুলে আনা এক কেজি মুলা বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন তিন টাকা। এক সপ্তাহ আগে হাটে পাইকারি পর্যায়ে মুলার দাম ছিল ৮ টাকা। গড়ে দেড় কেজি ওজনের বাঁধাকপি বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন তিন টাকা। এক সপ্তাহ আগে এক কেজি ওজনের বাঁধাকপির পাইকারি দাম ছিল ১০ টাকা। এ ছাড়া এক কেজি ওজনের একটি ফুলকপি বিক্রি করে কৃষক দাম পেয়েছেন পাঁচ টাকা।

কৃষকরা কমমূল্যে সবজি বিক্রি করলেও ভোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না। কৃষক আর বাজারের মধ্যে দামের বড় ফারাক থাকায় ঠকছেন ভোক্তা ও কৃষক উভয়েই। কৃষকের ঘাম ঝরানো কষ্টের ফসলের লাভ খাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা। উৎপাদন বাড়লে কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য মিলে না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাই কৃষক ও ভোক্তাদের মধ্যে ফারাক কমিয়ে আনতে সারাদেশে জেলা ও বিভাগীয় এবং ঢাকায় কৃষক বাজারের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে দেশে একটি প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন বছরের শুরুতেই ফসলভিক্তিক পণ্যের আগাম মূল্য নির্ধারণ করে দেবে।

শীতের সবজি বাঁধাকপির দাম নেই। প্রতিটি বড় সাইজের বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ফসলের খেতে মাত্র দুই টাকা করে। অথচ একটি বাঁধাকপি জমি তৈরি, চারা রোপণ, পরির্চযা, সার, পানি, কীটনাশক প্রয়োগ মিলে উৎপাদন খরচ পড়ে গেছে কম করে হলেও ১০ টাকা। শীতের সবজির দাম না পেয়ে কৃষক হতাশ। খেতে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। দাম না থাকায় জমি হতে বাঁধাকপি উত্তোলনের খরচ উঠছে না। তাই সবজি খেতে বাঁধাকপি পড়ে আছে। বাঁধাকপির খেত নষ্ট হচ্ছে। বাজারে নিয়ে বিক্রি করলে পরিবহণ ভাড়া ওঠে না। অনেকেই বিরক্ত হয়ে গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছে সবজি। এসব কথা জানালেন মেহেরপুর সদর উপজেলার শোভরাজপুর গ্রামের সবজিচাষি কৃষক আহম্মদ আলী সরকার।

বিভিন্ন ধরনের সবজিচাষ করে বাজারে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিশেহারা কৃষক। জেলায় মুলা ২ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা ও বাঁধাকপি তিন থেকে চার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় উৎপাদিত সবজি এখন পানির দামে বিক্রি করছেন কৃষকরা। বাজারে দাম কম, তাই চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সবজির চাষ করে কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে রাজশাহীর বাগমারা এলাকায়; ফুলকপি ও বাঁধাকপির কদর এখন কমে গেছে। জমি পরিষ্কার করার জন্য কৃষক এখন এই ফুলকপি ও বাঁধাকপি এনে খুরচা ও পাইকারি বিক্রেতাদের দিয়ে যাচ্ছেন। তারা এই কপি নিয়ে পড়েছে বিপাকে। দিনের পর দিন এসব বিক্রি না হওয়ায় অবশেষে দোকানিরা এসব সবজি ফেলে দিচ্ছে অথবা গরুর খাওয়ার জন্য দিয়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি উপজেলা ভবানীগঞ্জ ও তাহেরপুর হাটে এমন চিত্র ওঠে আসে।

বাজারে এখন শীতকালীন সবজির কদর কমেছে। বাজারে নতুন করলা ও পটল ওঠা শুরু হয়েছে। তাই এখন ক্রেতারা শীতকালীন সবজি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে এসব সবজি এখন গরু, ছাগল ও ক্ষেত্র বিশেষে মাছের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। নরসিংদীর কৃষক লুৎফর রহমান জানান, তিনি এবার আড়াই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ করেছিলেন। দাম না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করলেন।

কৃষিবিদ ড. হামিদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কৃষির বড় দুর্বলতা- কৃষককে বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারা। বাণিজ্যিক কৃষি এগিয়ে নিতে এখনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এগুলো দার্শনিকগতভাবে আমাদের বড় অসফলতাও। কৃষক যে দাম পান এবং ভোক্তা যে দামে পণ্য কেনেন, তার পার্থক্য অনেক বেশি। এটি কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন। বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেছে, অতিরিক্ত মূল্যের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। মধ্যস্বত্বভোগীরাই মূলত এর ভাগীদার। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে আবার কৃষি পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণও সম্ভব নয়। ফলে এ দুয়ের মধ্যে আরো সুসম্পর্ক প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন উন্নত কৃষি ব্যবস্থা। কৃষি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমেই দেশের বিস্তৃত গ্রামবাংলা ও পলস্নী অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহের প্রধান বিষয় দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি ও সুস্বাস্থ্য অর্জনের জন্য কৃষি খাতের ধারাবাহিক পরিচর্যা প্রয়োজন। তাহলেই এ খাত থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় দেশের অর্জিত সাফল্য বজায় রাখার জন্য, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এবং সব ধরনের শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে জাতীয় কৃষি নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করেছে। উন্নত উপকরণ ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেকৃষি পণ্যের উৎপাদনে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো-২০২১ সালের ভেতর মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়া। উন্নয়নের বর্তমান ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য' (এসডিজি) খাদ্য, দারিদ্র্য, ক্ষুধা বিষয়ক সব লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ। সেখানে কৃষকে দামে বঞ্চিত করে এসব লক্ষ্য অর্জন দুরূহ হবে। তাই কৃষকের স্বার্থে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষি ও কৃষকের গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য সার, সেচ ও বিদু্যতের পাশাপাশি যান্ত্রিকীকরণ, পোস্ট হারভেস্ট লস বা ফসলোত্তর ক্ষতি কমাতে প্রযুক্তি, প্রক্রিয়াজাতকরণে সহায়তা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। কৃষককে দক্ষ করে তুলতে হবে। খাদ্য শস্যের মজুত সক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে তেমনি খাদ্য শস্য মজুত রাখতে হবে পরিমাণ মতো। আবার কৃষি পণ্যের দাম নিশ্চিত করতে হলে নজর দিতে হবে উৎপাদন খরচ কমানোতে। তা না হলে কৃষিকে প্রতিযোগী সক্ষম করে তোলা যাবে না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব যথা- বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা ইত্যাদিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে সৃষ্ট সংকট দূরীকরণের জন্যও পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য।

দেশে সবজির চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বাড়ছে। আর বহির্বিশ্বে চাহিদা বাড়ছে। ফলে দেশের সবজি রপ্তানি বাড়ছে। আগে টমেটো, লাউ, কপি বা নানা পদের সবজি শীতকাল ছাড়া বাজারে মিলতো-ই না। এখন প্রায় সারাবছরই বাজারে হরেক রকমের সবজি পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকরা সারাবছরই ৬০ থেকে ২০০টি ধরনের সবজি উৎপাদন করছেন। এসব সবজির ৯০ শতাংশ হাইব্রিড বীজ থেকেই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নতজাত এবং সরকারের বিভিন্ন সহায়তার সঙ্গে কৃষকের পরিশ্রম যুক্ত হয়েই এ সফলতা এসেছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে