শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পানির ওপর শস্যখনি

এই প্রক্রিয়ায় অর্ধশতাধিক শাকসবজি ও মসলা জাতীয় ফসল এবং এর চারা উৎপাদন করা যায়। সবজির মধ্যে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পেঁপে, শিম, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, করলা, শসা, ডাঁটা, ঢেঁড়স, মরমা, বরবটি, পানিকচু, মুলা, গাজর অন্যতম। শাকের মধ্যে পালংশাক, লালশাক, পুইশাক, ধনেপাতা, সরিষাশাক ও কলমিশাক উলেস্নখযোগ্য।
ম নাহিদ বিন রফিক
  ৩১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কৃষক, যারা কেবল চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে প্রতি বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলে প্রায়ই বন্যা দেখা দেয়। কোথাও কোথাও বছরের ৫ থেকে ৬ মাস, এমনকি তারও বেশি সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে জমিগুলো। এতে শস্যহানি কিংবা উৎপাদন ব্যাহত হয়। ওই সময় ফসল আবাদ বন্ধ থাকে। কাজে আগ্রহ হারিয়ে কৃষক ঘরে বসে অলস সময় কাটান। এরকম আর কতদিন! দরকার কিছু একটা করা। কোনো পথ না দেখে কেউ কেউ জলাবদ্ধ জমিতে চাষাবাদের বিকল্প উপায় খুঁজে ফেরে। দক্ষিণাঞ্চলের বেশ ক'টি গ্রামের চাষিরা অনেকটা এরকমই। ওখানকার কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগে উদ্ভাবন করেছেন ভাসমান কৃষির লাগসই প্রযুক্তি।

স্থানীয়ভাবে তৈরি বিশেষ এক পদ্ধতি। যদিও আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া নেই। তবে ষোলোআনাই পরিবেশবান্ধব। শুরুটা ঠিক কখন থেকে, সবারই অজানা। কম হলেও দেড়শ' বছরতো হবেই। সে থেকে পথচলা, আজও চলছে। ধারণা করা হয়, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের চাষিদের হাতেই এর প্রথম সূচনা। এরপর সম্প্রসারিত হয়েছে বরিশালের বানারিপাড়ায় এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদে। পরবর্তী সময়ে বরিশালের আগৈলঝাড়া, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া এবং টুঙ্গিপাড়ায়। এভাবে একেক করে ছড়িয়ে পড়ে সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন নিন্মাঞ্চলে। ভাসমান কৃষি পানিবন্দি কৃষকদের এক অনন্য আশীর্বাদ। এ প্রযুক্তিতে চাষাবাদ করে চাষিরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের জীবনমানও হয়েছে উন্নত। কৃষি ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। আর এ অর্জন আদায় করে নিয়েছে ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর সুনাম-সুখ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান পেয়েছে। তাদের গড়া এ প্রযুক্তি বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করে দিয়েছে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। তাই বলতেই পারি- এ তো পানির উপর শস্যখনি।

পানিতে ভাসে, তাই ভাসমান কৃষি। জলজ আগাছা দিয়ে ধাপে ধাপে সাজানো হয় বলেই এমন নামকরণ। প্রথমে পানির উপর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ যেমন- কচুরিপানা, দুলালিলতা, কলমিলতা এবং এ জাতীয় জলজ আগাছা স্তরে স্তরে সাজিয়ে এক ধরনের বেড তৈরি করতে হয়। এর উপর পচানো ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ যেমন- টোপাপানা, সোনা শেওলা, সে সঙ্গে নারকেলের ছোবড়ার গুঁড়া সমান করে বিছিয়ে দিতে হয়। ভাসমান বেডকে স্থানীয় ভাষায় ধাপ বলে। বেড সাধারণত ১শ' থেকে ২০ হাত (১শ' ৮০ ফুট) দৈর্ঘ্য, ৩ হাত (৪.৫ ফুট) প্রস্থ এবং ২ হাত (৩ ফুট) উচ্চতা হয়ে থাকে। এর নামকরণ এক রশি। আবার প্রতি ৬ হাত দৈর্ঘ্যকে বলে এক নল। কারো কারো ধাপ ৬০ হাত (৯০ ফুট) লম্বা হয়। আসলে জমির পরিমাণ অনুযায়ী ছোট-বড় হতে পারে। তবে এক রশির চেয়ে বেশি নয়। দৈর্ঘ্য কম বেশি হলেও প্রস্থ এবং উচ্চতা নির্দিষ্ট পরিমাণই রাখতে হবে। ধাপে সরাসরি বীজবপন সম্ভব নয়। তাই বিশেষ পদ্ধতিতে বীজ গজিয়ে পরে বেডে স্থানান্তর করতে হয়। এ কাজ মহিলারা করে থাকেন। টোপাপানা, শেওলা এ জাতীয় লতাগুলো হাতের তালুর একমুঠ পরিমাণ নিয়ে দুরালিলতা দিয়ে পেঁচিয়ে বলের মতো তৈরি করে। স্থানীয় নাম দৌলা। মেদাও বলে। দৌলার মধ্যে বাঁশের কঞ্চি ঢুকিয়ে ফসলের অঙ্কুরিত বীজ বসিয়ে দেওয়া হয়। পরে মাটিতে রেখে দেওয়া হয় এভাবে ৭-৮ দিন। একজন নারী গৃহস্থলীর কাজ শেষে দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৫শ' মেদা বানাতে পারেন। আর এ জন্য পারিশ্রমিক পান হাজারে ১০০ টাকা।

ধাপে প্রায় অর্ধশতাধিক শাকসবজি ও মসলা জাতীয় ফসল এবং এর চারা উৎপাদন করা যায়। সবজির মধ্যে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পেঁপে, শিম, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, করলা, শসা, ডাঁটা, ঢেঁড়স, মরমা, বরবটি, পানিকচু, মুলা, গাজর অন্যতম। শাকের মধ্যে পালংশাক, লালশাক, পুইশাক, ধনেপাতা, সরিষাশাক ও কলমিশাক উলেস্নখযোগ্য। আর মসলার মধ্যে আদা, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ এবং রসুন। এছাড়া তরমুজও আবাদ করা যেতে পারে। ভাসমান বেডে আমন ও বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করা যায়।

\হউৎপাদিত সবজির ধরন অনুযায়ী বেডে চারার সংখ্যা কমবেশি হয়। যেমন: লাউ ও বেগুনের চারা ৯ ইঞ্চি অন্তর। সে হিসেবে এক রশি ধাপে ২ হাজার ৫শ' চারা বসানো যায়। টমেটো ও শিমের দূরত্ব ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি। চারা বসে ৪ হাজার। তবে পেঁপে, মরিচ ও করলার ক্ষেত্রে ৪ ইঞ্চি। চারার সংখ্যা ৬ হাজার। দৌলায় জন্মানো চারা ধাপে রাখার ৭ থেকে ৮ দিন পর পচা কচুরিপানা বা এর শিকড় দিয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়। এ কাজকে স্থানীয় ভাষায় লাতা বলে। এতে চারার বাড়বাড়তি ভালো হয়।

ধাপ পানিতে ভেসে যেতে পারে। সেজন্য খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা প্রয়োজন। বন্যা যতই হোক, তেমন কোনো অসুবিধা নেই। তবে অতি বৃষ্টি ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এর প্রতিরোধ ব্যবস্থাও আছে। বাঁশের খুঁটির সাহায্যে বেডের উপর ছাউনি দিলেই নিরাপদ। যত্নআত্তি ঠিকমতো হলে ২৫ দিনের চারা বাজারজাতকরণের উপযুক্ত হয়। চাষিরা ৪ মাসে ৫ বার চারা উৎপাদন করে থাকেন। বাংলা আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস। বাকি সময় কেউ শাকসবজি, কেউ আবার বোরো ধান আবাদ করেন। এক রশি ধাপ তৈরিতে খরচ হয় ১৩ হাজার টাকা। প্রতিবার সবজির চারা উৎপাদনের জন্য ৪ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে ৫ বারের খরচ ২২ হাজার ৫০০ টাকা। মোট ব্যয় ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা। চারা বিক্রি করে পাওয়া যায় ৬০-৬৫ হাজার টাকা। এছাড়াও অকেজো ধাপ ২ হাজার টাকা বিক্রি করা যায়।

বল বা দৌলার মধ্যে বীজ ঢুকানোর আগে অবশ্যই ছত্রাকনাশক (রাসায়নিক) দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। অতিবৃষ্টির কারণে ছত্রাকজনিত রোগ যেমন: চারার কান্ড পচা, পাতায় ফোঁটা দাগ এবং পাতা পোড়া এসব রোগ দেখা দিতে পারে। প্রতিকারের জন্য জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা দরকার। এক্ষেত্রে বায়োডার্মা ভালো কাজ করে। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো রাসায়নিক কীটনাশক নয়। কেবল আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ফেরোমন ফাঁদ, বিষটোপসহ অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। কুমড়াজাতীয় ফসলের মাছি পোকা দমনের জন্য আকর্ষণ ও মেরে ফেলা পদ্ধতি বেশ কার্যকরী। ইঁদুরের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটা পলিথিন সীট দিতে হবে। এর ১ ফুট পরিমাণ সীট এমনভাবে স্থাপন করতে হবে, যেন কিছু অংশ বেডের নিচে থাকে। বেডে ব্যবহৃত খুঁটিও পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া দরকার। চারার গোড়া যেন শুকিয়ে না যায়, তাই প্রতিদিন হালকা সেচ দিতে হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তরল আকারে দেওয়া উত্তম। লতাজাতীয় ফসলের জন্য মাচার ব্যবস্থা থাকা চাই। এক্ষেত্রে নেট ব্যবহার করলে খরচ কম হবে।

প্রচলিত পদ্ধতিতে ভাসমান বেডে ফসলের ফলন কম হয়। তাই দরকার আধুনিকায়ন। আর এজন্য চাই বেড উন্নয়ন, উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার, ফসলের বহুমুখীকরণ, মানসম্পন্ন চারা উৎপাদন, সুষম সার ব্যবহার, উপযোগী ফসল বিন্যাস এবং রোগপোকার সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা। ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য বেডের উচ্চতা ৪ ফুট হওয়া দরকার। তবে হলুদ ও আদার ক্ষেত্রে ৫ ফুট হতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সূত্রমতে, এ দেশে মধ্যনিচু হতে অতিনিচু জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর- যা মোট ভূমির শতকরা প্রায় ২১ ভাগ। এসব স্থানে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল আবাদ করা জরুরি। কারণ, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে অসময়ে বন্যা, জলমগ্নতাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে। তাই প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য এ পদ্ধতি সম্প্রসারণে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ধরনের নিরাপদ ফসল উৎপাদনে অপরকে করতে হবে উৎসাহিত। তবেই দেশ হবে কৃষিতে আরো সমৃদ্ধ।

লেখক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে