রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার ফল ও ফসল নষ্ট করছে ইঁদুর!

ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক্ত ও নিশাচর প্রাণী। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের শত্রম্ন। মানুষের আশপাশে থেকেই এরা মাঠে, গুদামে, বাসাবাড়িতে, অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। এশিয়ায় ইঁদুর বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৬০-৭৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসল ও অন্যান্য জিনিসপত্রের প্রায় ১.৫-২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ইঁদুর পেস্নগসহ প্রায় ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। শাকসবজি ও ফলে প্রধানত দুই জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে- যা মাঠের কালো ইঁদুর ও গেছো ইঁদুর বা ঘরের ইঁদুর নামে পরিচিত।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ইঁদুর বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ফল ও ফসল নষ্ট করছে। দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ১৫ শতাংশ ইঁদুরের পেটে যায়। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে ইঁদুরের কারণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গম ৪ থেকে ১২ ভাগ, গোল আলু ৫ থেকে ৭ ভাগ, আনারস ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট হয়। ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচনালাও নষ্ট করে থাকে। ইঁদুর যে শুধু দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, এ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল, আসবাবপত্র ক্ষতি সাধন করে- যেমন: নারিকেল, ডাল, অন্যান্য সবজি ইত্যাদি। বৈদু্যতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহায় পায় না। তাছাড়া ইঁদুর বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও কেটে নষ্ট করে।

বিশ্বের অন্যতম ইঁদুরের উপদ্রম্নত এবং বংশ বিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রক্ষ্ণপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশ বিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাটবাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের বংশবিস্তার বেশি পরিলক্ষিত হয়। সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল- রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রেতার দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করে। ইঁদুর বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের একটি প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে ইঁদুরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে সময়ে সময়ে ইঁদুর ফসল ও কৃষকের শত্রম্ন হিসেবে হানা দেয় ফল, সবজি ও ফসলের ক্ষেতে।

এশিয়ার দেশগুলোতে বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে ইঁদুর। বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের খাবার খেয়ে নেয় ইঁদুর। ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন। দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এরপরই লাওস। দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায়। ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হিসাবে ১১টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এ ছাড়াও ইঁদুরের মাধ্যমে মোট ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্ছা খেয়ে ফেলে।

ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক্ত ও নিশাচর প্রাণী। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের শত্রম্ন। মানুষের আশপাশে থেকেই এরা মাঠে, গুদামে, বাসাবাড়িতে, অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। এশিয়ায় ইঁদুর বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৬০-৭৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসল ও অন্যান্য জিনিসপত্রের প্রায় ১.৫-২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ইঁদুর পেস্নগসহ প্রায় ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। শাকসবজি ও ফলে প্রধানত দুই জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে- যা মাঠের কালো ইঁদুর ও গেছো ইঁদুর বা ঘরের ইঁদুর নামে পরিচিত।

সব রকমের কৃষিজাত ফসলেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া শহর এলাকা, ঘর বাড়ি এবং গুদামেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মাঠের কালো ইঁদুর মাঠ ফসলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির, ওজন প্রায় ১৫০-৩৫০ গ্রাম, পশম কালো ও ধূসর রঙের। মাথা ও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যের তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। ফলগাছ ছাড়া সব ধরনের কৃষিজাত ফসলে এরা প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানেই গর্ত করে, ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে, গুদামে খেয়ে, পায়খানা ও পশম, মাটি ও শস্যের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। গেছো ইঁদুর সাধারণত মাঝারি ধরনের, লম্বাটে, লালচে বাদামি বণের্র হয়ে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় এদের ওজন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম। শরীরের নিচের দিকটা সাদাটে বা হালকা বণের্র। এই জাতের ইঁদুর গুদাম জাত শস্য, ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদির ক্ষতি সাধন করে থাকে। এরা মাটিতে গর্ত না করে ঘরের মাচায় বা গুপ্ত স্থানে অথবা গাছে বাসা তৈরি করে বংশবৃদ্ধি করে। এদের সাধারণত মাঠে কম দেখা যায়, তবে বাড়ির আশপাশে, উঁচু এলাকায় ও নারিকেল জাতীয় গাছে বেশি দেখা যায়।

ইঁদুর সব রকম সবজিতে আক্রমণ করে থাকে তবে চারাগাছ ও পরিপক্ব অবস্থায় বেশি ক্ষতি করে থাকে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মরিচ, ব্রোকলি এবং বেগুনের চারা ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হয়। মাঠের কালো ইঁদুর জমিতে গর্ত করে এবং গাছের লতাপাতা কেটে দেয় ও গর্তে নিয়ে জমা করে পরবর্তী পর্যায়ে যখন ফল ধরে তখন ফল খেয়ে নষ্ট করে ও ফল পচে যায় এবং খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজির ও অনেক ক্ষতি করে থাকে। মিষ্টিকুমড়া, করলা, তরমুজ, বাঙি, লাউ, শশা ইত্যাদি কুমড়াজাতীয় সবজি ক্ষেতে ইঁদুর প্রথমে এলোমেলোভাবে গর্ত করে মাটি উঠিয়ে ডিবি করে এবং গাছের লতাপাতা কেটে দেয় ও গর্তে নিয়ে জমা করে। পরবর্তী পর্যায়ে গাছে ফল ধরলে ইঁদুর ফল খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে ও ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে ইঁদুর সবজি ক্ষেতে ক্ষতি করে থাকে। মাঠের কালো ইঁদুর সবজি ক্ষেতে প্রধানত বেশি ক্ষতি করে থাকে। গোলআলুর ক্ষেতে গাছের পাতা বৃদ্ধির সময় ইঁদুর প্রথমে মাঠে গর্ত করে মাটি উপরে উঠিয়ে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর আলুর মাটির ওপরের গাছ ও ডগা কেটে দেয়। আলু ধরার সময় ইঁদুর গাছের শিকড় কেটে দেয়। তারপর আলু যখন বড় হয় তখন ইঁদুর মাটির নিচের আলু গর্ত করে খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত ইঁদুর আলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ ক্ষতি করে থাকে। মিষ্টিআলুর ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ আলু থেকে বেশি দেখা যায়। মিষ্টিআলুর ক্ষেত লতায় ঢেকে যায় ফলে ইঁদুর প্রচুর গর্ত করে ডগা ও লতা কেটে গর্তে নিয়ে যায়।

নারিকেল, কমলালেবু, জম্বুরা, আনারস, পেঁপে ইত্যাদি ফলে ইঁদুর অনেক ক্ষতি করে। বিভিন্ন ফলের চারাগাছ এবং পরিপক্ব ফলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। পেঁপে ও নারিকেলের চারা ইঁদুর দ্বারা অনেকটা ক্ষতি হয়। চারা অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কমলালেবু, জাম্বুরা, মাল্টা ফলের শাস খেয়ে ফেলে- যার ফলে খাবারের অনুপযোগী হয়ে যায়।

সাধারণত গেছো ইঁদুর নারিকেলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। একটি জরিপে দেখা যায় যে, পরিপক্ব নারিকেলের চেয়ে কচি ডাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। ফলে ডাব ছিদ্র যুক্ত হয়ে যায় এবং গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। এতে নারিকেল পরিপক্ব হতে পারে না এবং ফলন অনেক কমে যায়। বাংলাদেশে দক্ষিণ অঞ্চল বরিশাল, খুলনায় নারিকেলের বেশি ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়।

দুই ধরনের ইঁদুর আনারসের ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত আনারসের নিচের দিকে যেখান থেকে পাকা আরম্ভ করে সেখান থেকে ২-৩ ব্যাসাধের্র বাঁকানো গর্ত করে আনারসের ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর কোনো কোনো সময় চিবিয়ে আনারসের ক্ষতি করে থাকে। ফলে বাজারে এর দাম কমে যায় এবং আনারসের ছত্রাক রোগ হয়ে পচে নষ্ট হয়। এভাবে আনারসে প্রায় শতকরা ৬ থেকে ৯ ভাগ ক্ষতি করে থাকে।

গ্রীষ্ম মৌসুমে ইঁদুর সাধারণত ফসলের ক্ষেতে ও গ্রাম এলাকার বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নিন্মভূমি পস্নাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ ও পুরোনো স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। আর ওই ফুটো দিয়ে পানি প্রবেশ করে বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইঁদুর দমনে ধানের জমিতে ফাঁদপাতা সবচেয়ে কার্যকরী। ফাঁদে টোপ হিসেবে শামুকের মাংস, ধান, নারিকেলের শাঁস, কলা ও শুঁটকি মাছ ব্যবহার করলে ইঁদুর বেশি ধরা পড়ে। তাছাড়া ধান বা চালের সঙ্গে নারিকেল তৈল টোপ হিসেবে ব্যবহার করলে বেশ কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায়। শস্য গুদাম এবং বসতবাড়িতে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে আঁঠাযুক্ত ফাঁদ বেশি কার্যকরী। ফসল কাটার পর ধানের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে বা সরিয়ে ইঁদুরের সংখ্যা সীমিত করা যায়। ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ফল গাছে ইঁদুর দমন করা যায়। এক্ষেত্রে টিনের পাত লাগানোর পূর্বে গাছকে ইঁদুর মুক্ত করতে হবে। নিবিড়ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরণ ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। সাধারণত যেখানে ইঁদুর দেখা যায় এবং যেখান দিয়ে ইঁদুর চলাফেরা করে যেমন দেয়ালের পার্শ্ব, চালের উপর, গাছের উপর বা গর্তের কাছাকাছি সেখানে ফাঁদ স্থাপন করা উচিত। বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে