রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপস্নব

এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে- জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি। এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে
ইমরান ছিদ্দিকি
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম ছোট দেশ বাংলাদেশ। এখন ফল উৎপাদনে সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে এই দেশ। স্বাধীনতার পর আমের উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ মূলত নিজের জন্য বসতবাড়িতে বাগান বা ফলের চাষ করত। তবে সময়ের পরিবর্তনে কৃষকরা এখন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছেন। গত ২ দশক ধরে বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপস্নব ঘটেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১০টি শীর্ষ গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল উৎপাদনকারী দেশের একটি। এ ছাড়া গত ১৮ বছর ধরে ফল উৎপাদনে গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশে ফল চাষের জন্য সীমিত পরিমাণ জমি থাকা সত্ত্বেও এ খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে- জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি। এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ফল উৎপাদনে একটি নীরব বিপস্নব ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো নতুন নতুন এলাকা বাণিজ্যিক ফল উৎপাদনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা এখন ফল রপ্তানিও করছি। স্ট্রবেরি, রামবুটান ও ড্রাগন ফ্রুটের মতো বিদেশি ফলও সম্ভাবনাময়। ফল সংরক্ষণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ জন্য সরকার পার্টনার নামে একটি প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা চালুর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া কীভাবে আরও বেশিদিন ফল সংরক্ষণ করা যায়, তা খুঁজে বের করতে আমরা বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করছি।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে মানুষ যেমন তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে, সেই সঙ্গে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে ফলের চাহিদা বেড়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে আরও বেশি কৃষক ফল উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাত্তার মন্ডল বলেন, যেহেতু প্রধান খাদ্য হিসেবে ধান ততটা লাভজনক নয়, তাই বিপুলসংখ্যক কৃষক ফল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষকরা ফল চাষের জন্য প্রতিটি সম্ভাব্য জায়গা ব্যবহার করছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের মাটি মাল্টা, স্ট্রবেরি ও ড্রাগন ফ্রুটের মতো বিদেশি ফল চাষের জন্যও অনুকূল। এমনকি এক দশক আগেও বেশির ভাগ স্থানীয় ফল গ্রীষ্মকালের শুষ্ক আবহাওয়ায় মাত্র ৩ মাস পাওয়া যেত। মানুষ অধীর আগ্রহে সারা বছর অপেক্ষা করত মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য; যে সময় আম, লিচু, কাঁঠাল ও অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন ফল বাজারে আসবে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে এখন বছরজুড়ে পেয়ারা, কলা, পেঁপে ও আরও কিছু ফল পেতে পারি। এ ছাড়াও, আম মৌসুমের আগে ও পরে ফলন হয়, এর রকম জাতের প্রচলনের কারণে আমরা সারা বছরই এই জনপ্রিয় ফল সহজলভ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম; কিন্তু জনসংখ্যায় অষ্টম বাংলাদেশ। সবচেয়ে কম জমি, আর বেশি মানুষের এই দেশ ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে। একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। এত কম আয়তনের দেশ হয়েও ফল চাষে জমি বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। চলতি বছর তা ৮৫ গ্রামে উঠে এসেছে।

গত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, এ বছর দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ফল ড্রাগন ও অ্যাভোকাডো এবং দেশি ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, খরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর মতো পুষ্টিকর ফলের উৎপাদনও ব্যাপক হারে বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এক যুগ আগেও দেশে ৫৬ প্রজাতির ফলের চাষ হতো। বর্তমানে ৭২ প্রজাতির ফল চাষ হচ্ছে। আরও ১২ প্রজাতির ফল বাংলাদেশের চাষ উপযোগী করার জন্য গবেষণা চলছে। এর মধ্যে চার প্রজাতির ফল ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে সফলভাবে চাষ হয়েছে। নতুন করে চাষ শুরু হওয়া ফলের মধ্যে ড্রাগন ফলের ২৩টি আলাদা প্রজাতি, খেজুরের ১৬টি, নারকেলের ২টি প্রজাতি, কাঁঠালের ১টি, আমের ৩টি নতুন প্রজাতি চাষের প্রাথমিক সফলতা পাওয়া গেছে। এফএওর হিসাবে, গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে আমের উৎপাদন বাড়ায় এর মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ১০ বছর আগে বিশ্বের আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে উঠে এসেছে। দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টির চাহিদার বড় অংশের জোগান দেয় আম।

আম ছিল শুধু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ফল। বর্তমানে ৩০ জেলায় আমের চাষ হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। ১০ বছর আগে যা ছিল ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন। তবে কাঁঠালের মতো আমও বাংলাদেশে মৌসুমি ফল হিসেবে চাষ হচ্ছে। পেয়ারা উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। এই অর্জন হয়েছে গত ১০ বছরে। ২০০৭-০৮ সালে দেশে পেয়ারা হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে তা প্রায় ৫ লাখ ১৬ হাজার টনে উন্নীত হয়। এক সময় শুধু দেশি পেয়ারার চাষ হতো। এক যুগ আগে আসে কাজি পেয়ারা। বিদেশি জাতের সঙ্গে মিশ্রণে উদ্ভাবিত ওই জাতের চাষ বেড়ে যাওয়ার পর থাইল্যান্ড থেকে বেশ কয়েকটি জাত আসে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চলতি বছর ১ কোটি ২১ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। ১০ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন ১৮ লাখ টন বেড়েছে। চাষের জমির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি জমিতে চাষ হচ্ছে কলা। তারপর যথাক্রমে আম, পেঁপে ও কাঁঠাল। সবচেয়ে দ্রম্নত হারে বাড়ছে পেয়ারা ও লিচুর আবাদ। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যতম পুষ্টিকর ফল ড্রাগন ফ্রুট, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, বেল, নারকেল, জাম্বুরা, রংগন, সূর্য ডিম ও খেজুরের বেশ কয়েকটি জাতের চাষও দেশে দ্রম্নত বাড়ছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে নানা রকমের ফল পাওয়া যায়। সারা বছর উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ (মে-আগস্ট) এ চার মাসেই বিভিন্ন রকম দেশীয় ফল পাওয়া যায়- তবে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আনারসই প্রধান। পাওয়া যায়- জাম, আমলকী, আতা, করমজা, জামরুল, বেল, গাব, কাঁচা তাল ইত্যাদি। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদন হয় ২১ শতাংশ- যার মধ্যে আমড়া, কামরাঙা, কদবেল, চালতা অন্যতম। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে উৎপাদন হয় মোট ফলের ১৯ শতাংশ, যার মধ্যে কুল, বেল, কলা, সফেদা অন্যতম।

বাংলাদেশের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ পাহাড়ি অঞ্চল। উদ্যান ফসলের মধ্যে বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। পাহাড়ে প্রায় ২০ রকমের ফল খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। বর্তমানে পাহাড়ে বেশ কয়েক রকমের ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে যেমন- আম, কলা, কাঁঠাল, লেবু ও আনারস। নতুন ফলের মধ্যে ড্রাগন ফল, মাল্টা ও কমলা চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বান্দরবানের রামুতে চাষ করা হচ্ছে কাজুবাদাম। খাগড়াছড়িতে প্যাসন ফল চাষের সফলতাও দেখা গেছে। ফল চাষে জমি বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বছরে ১০-১১ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম ও পেঁপেতে চতুর্দশতম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ ও ফুটি ইত্যাদি। একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে