রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি জাদুঘর ঐতিহ্যের এক ভান্ডার

মোছা. ফাতেমা তুজ্জোহরা
  ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

দেশের সর্ববৃহৎ কৃষি জাদুঘরটি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। রয়েছে সাত শতাধিক কৃষিজ উপকরণ। যার সিংহভাগই এখন বিলুপ্ত অথবা বিলুপ্তপ্রায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত এই কৃষি জাদুঘরটি দেশের কৃষি সম্পর্কিত ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। সম্প্রতি ঘুরে এলাম সেই কৃষি জাদুঘর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) সামনে জাদুঘরটি অবস্থিত। ২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. মুস্তাফিজুর রহমান জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।

পাঁচ একর আয়তনের জাদুঘরটি অষ্টাভূজী ভবন। ভবনের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে উন্মুক্ত জমি। যেখানে করা হয়েছে ফুলের বাগান। অফিসের জন্য দুটি কক্ষ এবং প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে ছয়টি কক্ষ। এসব কক্ষে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত কৃষক ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ।

বাঁশ, বেত, কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণ, আধুনিক কৃষি যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রাংশ, তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি উপকরণ, মাটির তৈরি উপকরণ, মাটি ও সারজাতীয় উপকরণ, বিভিন্ন ফসলের বীজ, বিরল প্রজাতির ধান, ঔষধি উদ্ভিদ ও ফলমূল, মাছ ধরার উপকরণ, ফরমালিনে সংরক্ষিত মাছ, প্রাণী ও প্রাণীর কঙ্কালজাতীয় উপকরণ, বাদ্যযন্ত্র বিশিষ্ট উপকরণ, অলংকারজাতীয় উপকরণসহ কৃষকের ব্যবহৃত উপকরণ।

জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে ছয়টি ডিসপেস্ন রুম। সেখানে বড় বড় কাচের তাকে সাজানো রয়েছে প্রায় সাত শতাধিক উপকরণ। জাদুঘরের প্রবেশ লবিতে প্রদর্শিত হয়েছে বিচিত্র সব মাছের অ্যাকিউরিয়ামসহ সাতটি খনার বচন। প্রথম এবং দ্বিতীয় ডিসপেস্ন রুমে রয়েছে নাম জানা-অজানা বিবিধ উপকরণের সমাহার। তৃতীয় ডিসপেস্ন রুমকে বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বলা যেতে পারে। কারণ এতে স্থান পেয়েছে বহুদিন ধরে বাংলায় গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত উপকরণ। বাকি ডিসপেস্ন রুমগুলোতে স্থান পেয়েছে জমি চাষাবাদের যন্ত্রপাতি এবং পূর্বে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাদি।

বাঁশ, বেত, কাঠ, লোহার উপকরণের মধ্যে টুকরি, মাথাল, ঝুড়ি, কাইলং, কুরুম, মুরগি খাঁচা, দা, কাঁচি, চালুন, কুলা, কোদাল, হুক্কা, কুড়াল, শাবল, লাঙল, জোয়াল, মই, ঢেঁকি, ডুলি, খাঁচা, ডালি, উড়ি, কুলা, বাওয়াস, শিকা, খৈ চালার চালুন, ঢেঁকি, বিন্দা, গাইল সেট, কড়ি, ডাবুর, মহেশখালীর কাঁচি, জাঁতা, দোন, পালকি, হ্যাজাকলাইট, হারিকেন, ডিমের খাঁচি, ঘানি, ধূপদানি, কুপি বাতি, গাছা, বতনা বাতি, নল বাতি, গ্যাস চুলা, নকশিকাঁথা, রুমাল, শীতল পাটি, চাটাই, মোসলা, হোগলা পাটি, বেতের মোড়া, বেত, রেহেল, পিঁড়ি, শিল-পাটা, ঢাকি, বাতিসেট, শঙ্খ, লোহার সিন্দুক, জল-চৌকি, চটি, কবুতরের খোঁপ, সের, ঢাকি, চামচাসহ আরও কত কি।

আধুনিক কৃষি যন্ত্রাংশের মধ্যে আছে সয়েল টেস্টিং কিট, সবজি বীজ শোধন যন্ত্র, সার-বীজ ছিটানো যন্ত্র, ধান মাড়াই যন্ত্র, স্প্রে মেশিন, ব্যালেন্স, পাওয়ার টিলার, ইনকিউবেটর, পাওয়ার স্প্রেয়ার, ফুট পাম্প স্প্রেয়ার, ইপিস্কোপ, শাক কাটার যন্ত্র ইত্যাদি।

আরও আছে তামা ও পিতলের ডেক, থালা, গস্নাস, জগ, বাটি, কলসি, পানথাল, বদনা, ঘটি, পুষ্পপত্র, হুক্কা, পানের ডাবর, ডেকচি, গামলা, হাঁড়ি, কড়াই, মালসা, বালতি, ঘটি, মাটির মটকা বা গজি, ডহি ঢাকনাসহ, পাতিল ঢাকনাসহ, সানকি, ভাতের থালা, মাটির তৈরি বাঘ, পিঠার ছাঁচ, জলকান্দা, মাটির ব্যাংক, পাতিল, মালসা, পুতুল, মাটির চুলা, মাটির চাড়ি, মাটির কলসি, ঝাঞ্ঝরের তলা, তরকারির পাতিল।

বিরল প্রজাতির অনেকগুলো ধানের জাত সংরক্ষিত আছে কৃষি জাদুঘরে। বাইলাম, কাইশাবিন্নি, নাজিরশাইল, কটকতারা, পাইজং, বোরো, কুমড়ি, লক্ষ্মীবিলাস, হনুমানঝটা, গোবিন্দ ভোগ, জামাই ভোগ, মোগাই বালাম, হরিংগাদিয়া, পক্ষীরাজ, মালা, বেগুনবিচি, হাসিকমলি, লতিশাইল, ইরিধান, বিরই, রাধুনি পাগল বা পাংকাশ, নোনাকুচি, পাকড়ি, জিংগাশাইল, তিলকাবুর, চিনিসাগর, সোনামুখী, সূর্যমুখী, খেজুর জুপি, কলস আটি, দুলাভোগ, ঈরাবিন্নী, কাঠারি ভোগ, দাদখানি, বটেশ্বর, ফুলবাদাল, সরিষাবাড়ি, সরিষাফুল মধুশাইল, ডাঁশফুল, ঘিগজ, রাজাশাইল, মধুমালতি, যাত্রামুকুট, জলকুমারি, বেনামুড়ি, পাটঝাক, কালামানিক।

এ ছাড়া ঔষধি উদ্ভিদ ও ফলমূল কাইজেলিয়া, বিলম্বী, আমলকী, হরতকী, বহেরা, জয়ফল, বেল শুঁটকি, অশ্বগন্ধা, নাগরমুখ, গোক্ষর কাঁটা, জৈন, অর্জুন ছাল, হালিম দানা, সোনাপাতা এবং মাছ ধরার লুই বা ওচা, বাইর বা ছই, তেরা, খালুই, চেং, বাইর, চরকা ছিপ, উড়াজাল, কুচ, তেরা, টেপাই বা ধিয়াল, পলো, চান্দি বাইর, ডুবো ফাঁদ, উছা, ডোলা, মইয়া জাল, শাংলা জাল, নৌকা সবই আছে এখানে।

বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে একতারা, তরুই বাঁশের বাঁশি, দোতারা, লাউয়া, করতাল, খুনজুরি, জিপসি, তবলা, বেহালা, কাঠি ঢোল, হারমোনিয়াম নজর কাড়বে সবারই।

কৃষি জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আশরাফুজ্জামান বলেন, 'কৃষি সংশ্লিষ্ট বিশাল সংগ্রহশালা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। জাদুঘরটি পরিদর্শনের মাধ্যমে শহরের ইট-পাথর, কাচঘেরা মানুষ খুব সহজেই গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি ও হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। আমাদের সংগ্রহে প্রায় সাত শতাধিক কৃষি উপকরণ রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক শতাধিক দর্শনার্থী এখানে আসেন। শুক্রবার ছাড়া বাকি সব দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এ জাদুঘর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে